
স্টাফ রিপোর্টার ॥
শখের বসে রঙিন মাছ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মোমিনপুর এলাকার রাশেদ শাহরিয়ার রিফাত (২০) নামের এক তরুণ উদ্যোক্তা। পড়াশোনার পাশাপাশি রঙিন মাছ চাষ করে জীবন রাঙাচ্ছেন তিনি। বাহারি রঙের মাছ চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন। এই রঙিন মাছ বাসাবাড়ির অ্যাকুরিয়ামে শোভা পেয়ে থাকে। ছোট-বড় এই মাছগুলো দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। সাড়ে ছয় বছর আগে ছয় হাজার টাকা নিয়ে শখ করে মাছ পালন শুরু করেন। আর এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন রঙিন মাছ। জেলার বিভিন্ন উপজেলার ব্যবসায়ীরা পাইকারিভাবে ক্রয় করেন রাশেদের কাছ থেকে।
সরেজমিনে দেখা যায়, স্যানেটারীর পাটে লাল, নীল, কমলা, কালো, বাদামি, হলুদ রঙের নানা রকমের মাছের ছড়াছড়ি। পানিতে ভাসছে, ডুব দিচ্ছে ছোট-বড় নানা রঙের মাছ। বর্ণিল মাছ দেখলে চোখ জুড়ায়, মন ভরে যায়। প্রায় ২৮ প্রজাতির মাছ রয়েছে তাঁর এই খামারে। রাশেদ শাহরিয়ার রিফাত মধুপুর উপজেলার কুড়াগাছা ইউনিয়নের মোমিনপুর গ্রামের এডভোকেট এম এ রশীদের ছেলে। রাশেদ শাহরিয়ার রিফাত টাঙ্গাইল টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা শেষ করেছেন।
রঙিন মাছ চাষ করা রাশেদ শাহরিয়ার রিফাত বলেন, বিগত ২০০৯ সালে ছোট বেলায় টাঙ্গাইল শহরে বাণিজ্য মেলায় গিয়েছিলাম। তখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। সেখান থেকে তাঁর বাবা তাঁকে দুটি অ্যাঞ্জেল মাছ কিনে দেন। মাছ দুটি বাসায় একটি জারে চাষ করেন। তখন থেকেই অ্যাকুরিয়ামে রঙিন মাছের প্রতি আগ্রহ জন্মে। আমি বিগত ২০১৬ সালে প্রথমে রঙিন মাছগুলো ঢাকা থেকে শখের বসে নিয়ে এসেছিলাম। আমার অঞ্চলের কোনো জায়গায় এই মাছ পাইনি। সাড়ে ছয় বছর আগে ছয় হাজার টাকা নিয়ে মাছ চাষ শুরু করি।
রাশেদ শাহারিয়ার জানান, একপর্যায়ে দামি মাছ চাষের পরিকল্পনা শুরু করি। পরিকল্পনা থেকেই ৫ হাজার টাকায় দুই জোড়া অরেন্ডা, ৬ হাজার টাকায় দুই জোড়া কমটে, ৮ হাজার টাকায় দুই জোড়া কই কার্প এবং ২ হাজার টাকায় দুই জোড়া গোল্ডফিস আনি। এ মাছগুলোর চাহিদা বেশি। চাষ করলে বেশি দামে বিক্রি করে লাভবান হওয়া যাবে, এই ছিল লক্ষ্য। মাছগুলোর ডিম ফুটতো না। মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করেও লাভ হয়নি। পরে সাতক্ষীরার মৎস্যচাষী সাইফুল্ল¬াহ গাজীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁর পরার্মশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ায় মাছগুলোর ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। বিগত ২০১৮ সালে এ মাছগুলোর প্রথম চালান বিক্রি করেই ৪৫ হাজার টাকা পান। তখন সিদ্ধান্ত নেন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ মাছ চাষ করার। বাড়ির আঙ্গিনায় বড় আকারের চৌবাচ্চা তৈরি করেছেন।
কয়েক মাস চাষ করার পর দেখি মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাছ বৃদ্ধি পাওয়া পর রঙিন মাছ বিক্রির চিন্তা করি। প্রথমে উপজেলার বিভিন্ন দোকানে মাছ বিক্রি শুরু করি। আর এখন জেলার বিভিন্ন উপজেলার দোকানগুলোতে পাইকারি বিক্রি করা হচ্ছে। এখন প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার রঙিন মাছ বিক্রি করতে পারি। আমার কাছে ২৮ প্রজাতির রঙিন মাছ রয়েছে। প্রতিটি রঙিন মাছ ২০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে বিক্রি করা হচ্ছে। সাতটি স্যানেটারী পাটে ও দুইটি হাউজে রঙিন মাছ চাষ করা হচ্ছে। প্রতিটি স্যানেটারী পাটে ১০০০-১২০০ রঙিন মাছ রয়েছে। আর হাউজে রয়েছে বড় রঙিন মাছ। মাছের জন্য দুই বেলা সকাল ও বিকেলে ভাসমান ফিড খাওয়াতে হয়। খাবার বাবদ প্রতি মাসে ১৬ হাজার টাকার খরচ হয়। মাছের ইঞ্চি ধরে এই মাছগুলো বিক্রি করা হয়। এই মাছগুলো এখন দুইটি পুকুরেও চাষ করতেছি। এ পর্যন্ত আমার সাড়ে ছয় লাখ টাকার মতো লাভ হয়েছে।
রাশেদ শাহরিয়ার রিফাত আরও বলেন, প্রথম দিকে অনেকেই অনেক কথা বলেছে যে, এই মাছ চাষ করে কি হবে? দেশি মাছ তো অনেক লাভ। তারপরও আমি এই রঙিন মাছ চাষ করেছি। দেশি মাছ ১ কেজি বিক্রি করে যে পরিমাণ টাকা আয় হয়। রঙিন মাছ এক পলিথিন বিক্রি করে সে পরিমাণ টাকা আয় হয়। আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকার রয়েছে অনেক। তাঁরা যদি ইচ্ছে করে এই মাছ চাষ করতে পারবে সহজেই। শিক্ষিতরা এই মাছ চাষ করলে বেশি বুঝতে পারবে। যে কোনো মানুষ যদি রঙিন মাছ চাষ করে, তারা কখনও ক্ষতির সম্মুখীন হবে না। তারা ভাল আয়ের মুখ দেখবে, আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।
রাশেদের বাড়ির উঠানের পশ্চিম দিকে তাঁর চৌবাচ্চা। ১৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫ ফুট প্রস্থ চৌবাচ্চাটির ভেতরে আটটি ভাগে ভাগ করা। তার কোন ভাগে ছোট পোনা। কোন অংশে বড় মাছ। কোন অংশে মাঝারি মাছ। এভাবে ভাগ করা। রাশেদ চৌবাচ্চার বিভিন্ন অংশে খাবার ছিটান। মাছগুলো ভেসে উঠে খাবার খাচ্ছিল। মাছ দেখতে এসেছিলেন ধনবাড়ী উপজেলার ফিরোজ হাসান। তিনি জানান, রাশেদ শাহারিয়ার এ মাছ চাষ দেখে তিনও উৎসাহিত হয়েছেন। নিজের বাড়িতে এ মাছ চাষ করছেন। হাতে কলমে শেখার জন্য এসেছেন সেখানে। শুধু ফিরোজ নয়, মধুপুরের কাদরাইদ গ্রামের মাসুদুল রহমান নামের এক যুবকও মাছ চাষ শুরু করেছেন। রাশেদ শাহারিয়ার জানান, এখন মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। দিন দিন আয় বাড়ছে। আগামী দিনে দেশের বাইরেও মাছ রপ্তানি করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
এ ব্যাপারে মধুপুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা তারিকুল ইসলাম জানান, রিফাত আমাদের তালিকাভূক্ত একজন মৎস্য চাষি। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত রিফাতকে আমরা কারিগরি ও প্রযুক্তিগত ভাবে সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছি। তার এই রঙিন মাছের চাষাবাদ আরও বৃদ্ধি করার জন্য আমরা মৎস্য অধিদপ্তর থেকে তাকে মৎস্য ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। নতুন কোনো উদ্যোক্তারা যদি রঙিন মাছের চাষাবাদ করতে আগ্রহী থাকে, তাহলে উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।