সখীপুরের সাব্বির অপহরণ ও খুনের কৌশল শেখেন ইউটিউব দেখে

অপরাধ আইন আদালত টাঙ্গাইল লিড নিউজ সখিপুর

স্টাফ রিপোর্টার ॥
সামিয়ার বাবার কাছে মুঠোফোনে ‘ভয়েস খুদে বার্তা’ পাঠিয়ে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন সাব্বির মিয়া। তিনি টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার দাড়িয়াপুর উত্তরপাড়ার আনোয়ার হোসেনের ছেলে। তিনি নিজ গ্রামে ছোট একটি মুদিদোকান করতেন। গত বুধবার গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে আটক করে। পরে তিনি শিশু সামিয়াকে হত্যার কথা স্বীকার করেন।

ঋণের টাকার জন্য মানুষ চাপ দিচ্ছিলেন। তাই ঋণ পরিশোধের জন্য দেড় মাস আগে কাউকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা করেন সাব্বির মিয়া (২১)। ইউটিউবে অপরাধ-সংক্রান্ত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন চ্যানেলের ঘটনা দেখে বিভিন্ন কৌশল শেখেন। সেই কৌশল কাজে লাগিয়ে প্রতিবেশী শিশু সামিয়াকে (৯) অপহরণ করে হত্যা করেন তিনি।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দাড়িয়াপুর উত্তরপাড়া গ্রামের রঞ্জু মিয়ার মেয়ে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া ৬ সেপ্টেম্বর সকাল সাতটায় ওই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাইভেট পড়তে যায়। সকাল নয়টার পরও সামিয়া ফিরে না আসায় তার পরিবারের লোকজন খোঁজাখুঁজি শুরু করে। সকাল ১০টা ২৪ মিনিটে সামিয়ার বাবার মুঠোফোনে ইমু আইডি থেকে একটি ভয়েস খুদে বার্তা আসে। সেখানে জানানো হয়, সামিয়াকে অপহরণ করা হয়েছে। পাঁচ লাখ টাকা দিলে মুক্তি পাবে। এ ব্যাপারে ৭ সেপ্টেম্বর সখীপুর থানায় রঞ্জু মিয়া বাদী হয়ে মামলা করেন। পরদিন ৮ সেপ্টেম্বর সামিয়াদের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে একটি ধানখেতে কাদাচাপা অবস্থায় সামিয়ার লাশ পাওয়া যায়।

পুলিশ সূত্র জানায়, এ হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ও সখীপুর থানা-পুলিশের সমন্বয়ে একটি তদন্ত দল গঠন করা হয়। তদন্ত দলের সঙ্গে যুক্ত এক সদস্য জানান, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সাব্বিরের মুঠোফোন সেটটি চিহ্নিত করা হয়। সাব্বির তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে ভালো বোঝে। সন্দেহজনকভাবে সাব্বিরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বুধবার গোয়েন্দা পুলিশ আটক করে। পরে সাব্বির ঘটনার বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশকে জানান।

জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আহসানুজ্জামান জানান, জিজ্ঞাসাবাদে সাব্বির জানিয়েছেন, ঋণ পরিশোধের জন্য তাঁর টাকার খুব প্রয়োজন ছিল। এ জন্য দেড় মাস আগে সিদ্ধান্ত নেন অপহরণ করে মুক্তিপণ নেবেন। সেই টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করবেন। অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অভিজ্ঞতার জন্য ইউটিউবে তিনি বিভিন্ন অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা দেখতেন। সেগুলো দেখে বুঝতে পারেন এমন কারও সন্তান অপহরণ করতে হবে, যাঁদের চাওয়ামাত্রই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আছে। এ ছাড়া নিজ এলাকার কাউকে অপহরণের পর মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দিলে পরে বিপদে পড়তে হবে। তাই ইউটিউবে দেখা অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত নেন, অপহরণ করে হত্যা করবেন। পরে মুক্তিপণ নেবেন।

জিজ্ঞাসাবাদে সামিয়াকে অপহরণ ও হত্যার বর্ণনা দিয়ে পুলিশকে সাব্বির বলেন, সামিয়ার স্কুলের রাস্তায় সাব্বিরের দোকান। তাঁর দোকানের সামনে দিয়েই সামিয়া প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া-আসা করত। ঘটনার আগে সিদ্ধান্ত নেন সামিয়াকেই অপহরণ করবেন। ৬ সেপ্টেম্বর সামিয়া সকাল আটটার পর প্রাইভেট পড়ে নির্জন পথে একা বাড়ি ফিরছিল। পথে সাব্বির তাকে অপহরণ করে একটি বাঁশঝাড়ের ভেতর নিয়ে যান। সেখানে গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করেন। প্রায় ১০ মিনিট গলা চেপে রাখার পরও সামিয়ার মৃত্যু হয় না। তখন একটি দড়ি গলায় পেঁচিয়ে শ্বাস রোধ করেন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর বাঁশের ঝরা পাতা দিয়ে সামিয়ার লাশ ঢেকে দেন। পরে সাব্বির বাড়ি ফিরে যান। এরপর তাঁর মুঠোফোনে একটি ইমু অ্যাকাউন্ট খোলেন। সেই অ্যাকাউন্ট থেকে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে সামিয়ার বাবার মুঠোফোনে ভয়েস খুদে বার্তা পাঠান।
ওই দিন রাতে সাব্বির বাঁশঝাড় থেকে সামিয়ার লাশ নিয়ে ধানখেতে কাদামাটিতে চাপা দিয়ে রাখেন।

ইউটিউব দেখে সাব্বির নিজের কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করার অ্যাপের কথা জানতে পেরেছিলেন। সে অনুযায়ী তিনি মুক্তিপণ চাওয়ার জন্য একটি অ্যাপ ব্যবহার করে নিজের কণ্ঠ পরিবর্তন করে রেকর্ড করেন। এ ছাড়া এলাকা ছেড়ে গেলে পুলিশ বা স্থানীয় লোকজন সন্দেহ করতে পারেন, এটাও জেনে ছিলেন ইউটিউব থেকে। তাই তিনি এলাকা ছেড়ে যাননি। মুঠোফোনের সব রেকর্ড মুছে ফেলেছিলেন।

বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার সখীপুর থানায় সাংবাদিক সম্মেলনে সাব্বিরকে গ্রেপ্তারের কথা জানান।
গ্রেপ্তারকৃত আসামি সাব্বিরকে শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) টাঙ্গাইল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা সখীপুর থানার এসআই মাসুদ রানা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাব্বিরের বিরুদ্ধে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মনিরুল ইসলাম তাঁর বিরুদ্ধে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

১৯৬ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *