
প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষাস্তরের প্রথম ও প্রধান স্তর। এ স্তরের ভিত্তির উপরই নির্ভর করে আগামীর স্থাপনা। আমাদের ভবিষ্যৎ কর্ণধার, আগামীর স্থাপনার মূল উপাদান তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের ব্যবস্থাপনাই পারে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র তুল্য প্রজন্ম উপহার দিতে। মানব সম্পদ উন্নয়নের শর্ত হচ্ছে শিক্ষা। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ উত্তরসূরীদের প্রাথমিক শিক্ষার পথকে কিছু কন্টকাবদ্ধ করেছে। তাদের মধ্যে ঝরে পড়া, শ্রমজীবী শিশু, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু, অটিস্টিক শিশু, অশিক্ষিত বাবা-মা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া ইত্যাদি।
আমাদের দেশে শিক্ষার মান বাড়াতে এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বৃদ্ধিতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ও আবেগিক বিকাশ সাধন এবং সৃজনশীল, বিজ্ঞান মনস্কতায় ও উন্নত জীবনের দর্শনের উদ্বুদ্ধকরণের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনে বর্তমান সরকার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে পাঠ্যক্রম অনুসারে বছরের প্রথম দিনে বিনামূল্যে বই বিতরণ তথা বই উৎসব পালন, আকর্ষণীয় শ্রেণিকক্ষ, ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া বিতরণ, ডিজিটাল কনটেন্ট এ পাঠদান, হোম ভিজিট, মা সমাবেশ ও বিদ্যালয়গুলোতে খেলাধুলা বিনোদনের মাধ্যমে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
অপরদিকে আইন করে বন্ধ করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন। শিক্ষকগণ এখন শিক্ষার্থীদের জন্য ভীতি নয় বরং বন্ধু ও আস্থার আশ্রয়স্থল। শতভাগ শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদানসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলেও শতভাগ শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে আমি ক্লাস্টারের দায়িত্ব পালন কালে বিভিন্ন পরিদর্শনের প্রেক্ষিতে অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির ব্যাপারে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি অনেক অভিভাবক লজ্জায় তাদের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের বিদ্যালয়ে নিয়মিত পাঠাচ্ছেনা। অনিয়মিতভাবে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার কারণে এরা পাঠদান কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে না। পাঠদান কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সহায়ক উপকরণও নেই। তাদের কোন বন্ধু নেই। এছাড়া এসব শিশুদের বিশেষভাবে পাঠদানের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। এভাবে এক সময় তারা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে। চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের পড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা নেই। নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষা সামগ্রী। অথচ এ বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের তাদের দক্ষতা অনুযায়ী তৈরির সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে এরা মা-বাবা ও দেশের জন্য বোঝা না হয়ে আশীর্বাদ হয়ে গড়ে উঠবে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের বিদ্যালয়ে নিয়মিত করতে যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ
করতে হবে –
ক) অভিভাবকদের শিক্ষার প্রতি সচেতন করা।
খ) বাবা-মায়ের সাথে কাউন্সেলিং করা।
গ) সন্তান নিয়ে তাদের নিজেকে ছোট মনে না করা।
ঘ) তাদেরকেও সমান স্নেহ মায়া-মমতা ভালোবাসা দেয়া।
ঙ) শিক্ষার প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা।
চ) বিদ্যালয়ের যাতায়াত নির্বিঘœ করা।
ছ) প্রয়োজনীয় ডিভাইস বিতরণ
জ) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করা।
ঝ) শ্রেণীর সহপাঠীদের মিশতে উদ্বুদ্ধ করা।
দেশের স্বার্থে যে কোনো মূল্যে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুকে বিদ্যালয়মুখী করে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সহায়তায় তাকে বিশেষ পাঠদানের আওতায় নিয়ে আসা। এবং তার প্রতিভাকে বিকশিত হওয়ার
সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। যদিও বর্তমান সরকার এসব শিশুদের অ্যাসিস্টিভ ডিভাইস প্রদান করছে। কিন্তু শিক্ষকদের কোন প্রশিক্ষণ নেই। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় এনে এসব শিশুদের পাঠদান করা গেলে এবং তাদের দক্ষতা অনুযায়ী সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে এরা বাবা-মা এবং দেশের বোঝা না হয়ে আশীর্বাদ হয়ে গড়ে উঠবে।
পরিশেষে একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো অবশ্যই একদিন দূর হবে এবং জাতির পিতার যে স্বপ্ন সাধ নিয়ে এই জাতির পথ চলা শুরু হয়েছিল তাও অচিরেই পূর্ণ হবে বলে আমি আশা করি। আমরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দায়িত্ববোধ এবং সেবাধর্মী একটি জাতি হিসেবে সবাই একযোগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে কাজ করবো এই প্রত্যাশা রইল সংশ্লিষ্ট সবার কাছে।
লেখক-
শামীম আল মাসুদ রানা
সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, টাঙ্গাইল সদর।