মধুপুরে সাগর আলী নেশাখোর থেকে ছিঁচকে চোর ॥ অত:পর সিরিয়াল কিলার

অপরাধ টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল স্পেশাল মধুপুর লিড নিউজ

কাজল আর্য ॥
মাত্র ২০০ টাকার জন্য ৪ খুন। তারপর জেল থেকে বের হয়ে কবিরাজ সেজে আরো ৩ খুন। শুনলেই শরীর শিউরে উঠে। টাঙ্গাইলে মধুপুরের ব্রাহ্মণবাড়ী গ্রামের সাগর আলী (৩১) ছোটবেলায়ই নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। নেশার টাকা জোগাড় করতে ছোটখাটো চুরি করে এলাকা থেকে বিতাড়িত। পরে সিরিয়াল কিলার।
টাঙ্গাইলের মধুপুরে ৪ খুনের পর ঢাকার আশুলিয়ায় ৩ খুন করে র‌্যারে হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে খুনি সাগর দম্পতি। এতে দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। সাগরের নিজ এলাকার মানুষও একেবারে হতবাক। তারা সাগরের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। এসব ঘটনা রোধে আইনের শাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধ বাড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা।
কিন্তু সাগর কিভাবে এবং কি কারণে সাগর এমন ভয়ঙ্কর খুনিতে পরিনত হলো ? এসব বিষয়ে টাঙ্গাইল নিউজের সাথে কথা হয় তার প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের সাথে। মধুুপুর উপজেলা সদর থেকে দশ কিলোমিটার উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়ী গ্রামে সাগরের পৈত্রিক বাস।
সাগরের চাচাতো ভাই জমশেদ আলী টাঙ্গাইল নিউজকে বলেন, মৃত মোবারক হোসেন ও সাহেরা বেগমের ৬ সন্তানের মধ্যে সাগর সবার ছোট। সাগরের দিনমজুর বাবা শেষ বয়সে ভিক্ষা আর মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। ছোট বেলায় মা-বাবা মারা যাবার পর বোনের কাছে বড় হয় সাগর। প্রাথমিকেই অভাবে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। পরে নেশায় জড়িয়ে পড়ে। সেই নেশার টাকা জোগাড় করতে ছোটখাটো চুরিও করতো। এভাবে অপরাধে যুক্ত হতে থাকে। পরে একসময় ভিটা বাড়ি বিক্রি করে গ্রাম থেকে চলে যায়। জমশেদ আলী আরো বলেন, মধুপুরের ৪ খুনের মামলায় সাগর রাগের বশবর্তী হয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে আমাদের পরিবারের কয়েকজনকে জেল খাটিয়েছে। অথচ ওরা ঘটনার সাথে যুক্ত না। আমাদের বংশের একজন ছেলে সিরিয়াল কিলার হয়েছে এটা আমরা মানতেই পারি না। ওর ফাঁসি চাই। স্থানীয় ব্যবসায়ী মাসুদ হোসেন টাঙ্গাইল নিউজকে বলেন, বিগত ২০১০ সালে সাগর তার এক নিকট আত্মীয়াকে কুপ্রস্তাবসহ শ্লীলতাহানি করে। এতে গ্রামীণ বিচারে তাকে মারধর করা হয়। প্রতিবেশী হালিমা বেগম টাঙ্গাইল নিউজকে জানান, বাবা-মা হারিয়ে অনাদরে বেড়ে উঠে সাগর। উশৃঙ্খলতার কারনে পাড়াপড়শি ও ভাইবোনরাও তাকে অপছন্দ করতো। ফলে নিষ্ঠুর আচরণ নিয়েই সাগর বেড়ে উঠে। সংসার জীবনে সাগর বউকে খুব নির্যাতন করতো। ফলে প্রথম স্ত্রী তাকে ছেড়ে যায়।
মধুপুর উপজেলার মির্জাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও সাগরের গ্রামের বাসিন্দা সুজন মিয়া টাঙ্গাইল নিউজকে বলেন, সাগর দীর্ঘদিন ধরে এলাকা ছাড়া। শুনতাম মধুপুর শহরে বাসা ভাড়া করে থেকে রিকশা চালায়। মধুপুরে ৪ খুনের ঘটনায় জানতে পারি এটা আমাদের গ্রামের সাগর খুনি। ও একাধিক বিয়েও করেছে। মাদকাসক্ত সাগর নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় গ্রামের মানুষ তাকে ঘৃণা করতো। ছোট অপরাধ করে পার পেয়ে সে বড় অপরাধ করার স্পর্ধা পায়। আমরা গ্রামবাসী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। যাতে আর নিরপরাধ মানুষ খুনের শিকার না হয়। সাগরের দ্বিতীয় স্ত্রী আলেয়া বেগম টাঙ্গাইল নিউজকে জানান, রিকসা চালিয়ে নেশা ও সংসার দুটো চালানোয় অসুবিধা হওয়ায় এক পর্যায়ে নেশা দ্রব্যের ব্যবসা শুরু করে সাগর। এসবের প্রতিবাদ করায় তাকে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। নির্যাতন সইতে না পেরে তালাক দিয়ে সংসার ছাড়ে আলেয়া। সাগর পরপর চারটি বিয়ে করে।
তার সর্বশেষ স্ত্রী ইশিতা বেগম। যাকে কবিরাজ সাজিয়ে গত (২৮ সেপ্টেম্বর) সাভারের আশুলিয়ার জামগড়ার ফকিরবাড়ীর মেহেদী হাসানের মালিকানাধীন ছয়তলা ভবনের চারতলার ফ্লাটে গিয়ে ভাড়াটে স্বামী স্ত্রী ও সন্তানসহ তিনজনকে নেশা দ্রব্য খাইয়ে জবাই করে হত্যা করে। নিহতরা হলেন-ঠাকুরগাঁয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার লোহাগড়া গ্রামের মুক্তার হোসেন (৫০), স্ত্রী শাহিদা বেগম(৪০) এবং ছেলে মেহেদী হাসান(১২)। এ ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় গত সোমবার (২ অক্টোবর) র‌্যাব-১২ গাজীপুরের শফিপুর এলাকা থেকে সাগর ও স্ত্রী ইশিতা বেগমকে গ্রেফতার করে।
এদিকে বিগত ২০২০ সালের (১৫ জুলাই) মধুপুর উপজেলা সদরের মাস্টারপাড়ার আব্দুল গনি, স্ত্রী তাজিরুন বেগম, ছেলে তাজুল ইসলাম ও মেয়ে সাদিয়া নিজ বাসায় খুন হয়। সুদ ব্যবসায়ী আব্দুল গনির প্রতিবেশি ছিল সাগর। সুদের কিস্তি পরিশোধ না করেই ২০০ টাকা ধার চাওয়া নিয়ে মন কষাকষি হয়। এরই জেরে মিষ্টির সাথে ঘুমের ওষুধ দিয়ে দুই ঘাতকের সহযোগিতায় চারজনকে নৃশংসভাবে খুন করে সাগর। ঘটনার তিন দিন পর র‌্যাব-১২ সাগর ও তার দুই সহযোগিকে গ্রেফতার ও লুন্ঠিত মালামাল উদ্ধার করে। সাগর আদালতে গিয়ে হত্যাকান্ডে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। ঘটনার দেড় বছর পর টাঙ্গাইল পিবিআই আদালতে চার্জশিট দাখিল করে।
সাগরের বড় বোন মইফুল টাঙ্গাইল নিউজকে জানান, তার ভাই মানসিকভাবে অসুস্থ। তাকে খুনের নেশায় ধরেছে। ছাড়া পেলেই সে মানুষ খুন করবে। ওর সাজা হওয়া দরকার। এদিকে আশুলিয়ার ৩ খুনে সাগরের গ্রেফতার হওয়ার খবর গ্রামের মানুষ জানতে পেরেছে।
মধুপুরের ৪ খুনের মামলার বাদি এবং নিহত গনির পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য সোনিয়া বেগম টাঙ্গাইল নিউজকে জানান, সাগরের জামিন পাওয়ার বিষয়টি সরকারি আইনজীবী কখনোই তাকে জানান নি। আশুলিয়ার ট্রিপল মার্ডারে র‌্যাবের হাতে সাগর গ্রেফতার হওয়ার খবরটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য মধুপুর থানায় গিয়েছিলেন। পুলিশ তাকে নিশ্চিত করেছে। চার খুনের ভয়ানক খুনি আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জামিন নিয়ে এবার ট্রিপল মার্ডার করেছে। খুনের মামলায় সাজা হওয়ার আগেই সিরিয়াল কিলার সাগর সামনের দিনে আবারো জামিন পেলে বহু নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাবে সে। এজন্য তিনি নিজের নিরাপত্তা এবং পরিবারের সকল সদস্যের খুনের বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।
মধুপুর সার্কেলের এএসপি ফারহানা আফরোজ জেমি টাঙ্গাইল নিউজকে বলেন, সাগরের বিরুদ্ধে থানায় একটি মামলা রয়েছে। তার পরিবার অত্যন্ত গরীব। অনেক বছর ধরে সে এলাকা ছাড়া। শুনেছি সে কবিরাজি করতো।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের টাঙ্গাইল জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট খান মোহাম্মদ খালেদ টাঙ্গাইল নিউজকে বলেন, নেশার ভয়াবহতা, সামাজিক সম্প্রীতির অভাব এবং যথাযথ অভিভাবকত্বহীনতার কারনে সামজে সাগর আলীদের সৃষ্টি হচ্ছে। এরজন্য অসুস্থ রাজনীতির পৃষ্টপোষকতা এবং নেশা দমনে রাষ্ট্রীয় দুর্বলতাও দায়ী। ফলে আমাদের জীবন ও সামাজিক নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ে যাচ্ছে। এর প্রতিকারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক টাঙ্গাইল নিউজকে বলেন, সাগরের মতো খুনিকে বলা হয় সিরিয়াল কিলার। তারা একপ্রকার মানসিক রোগী বা বিকারগ্রস্ত। নেশায় আসক্ত হয়ে তারা বিবেকহীন ও বোধশক্তি হারিয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। তখন খুনসহ যেকোন ঘটনা ঘটাতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। এর প্রতিকারে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতের পাশাপাশি আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধ বাড়াতে হবে। শুরুতেই তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সবার সম্মিলিত উদ্যোগে নিতে হবে। ছোটবেলায় সমাজ থেকে তাদেরকে বিতাড়িত কিংবা অমানষিক চাপ দেওয়া যাবে না।

 

৩৬৪ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *