টাঙ্গাইল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মার্কেট নির্মাণের নামে লুটপাটের অভিযোগ

টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল সদর টাঙ্গাইল স্পেশাল লিড নিউজ শিক্ষা

স্টাফ রিপোর্টার ॥
টাঙ্গাইল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের জমিতে জননেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান খান ফারুক মার্কেট ও একাডেমিক ভবন নামে মার্কেট নির্মাণ করছেন বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কুদরত-ই-এলাহি খান। বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে তিন তলা ভবন নির্মাণ করে সেখানে মার্কেট স্থাপন করে বানিজ্য করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মার্কেট নির্মাণ বন্ধের দাবিতে বিদ্যালয়ের সাবেক, বর্তমান শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্যালয়ের সামনে ও শহরের নিরালা মোড়ে মানববন্ধন করেছেন। তারা দ্রুত এই অবৈধ মার্কেট নির্মাণ বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
জানা যায়, কুদরত-ই-এলাহি খান বিগত ২০১২ সাল থেকে টাঙ্গাইল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা (ম্যানেজিং) কমিটির সভাপতি পদে রয়েছেন। এছাড়াও তিনি ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে শহরের আলিয়া মাদ্রাসারও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। এছাড়াও তিনি টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের সভাপতি। ৯৬ শতাংশ জমির উপর প্রতিষ্ঠিত টাঙ্গাইল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ে পাঁচ তলা বিশিষ্ট একটি ভবন রয়েছে। এছাড়া রয়েছে একটি একতলা ভবন। বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে চারতলা একটি ভবনের নির্মাণের জন্য টাঙ্গাইল পৌরসভা থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। সেই ভবনের নিচতলায় টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা জননেতা ফজলুর রহমান খান ফারুক মার্কেট ও একাডেমিক ভবন নামে ব্যানার টানিয়ে মার্কেটের কাজ করা হচ্ছে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ বিদ্যালয়ের ছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক ও এলাকাবাসী।
বিক্ষুব্ধরা বলছেন, শহরের একটি বালিকা বিদ্যালয়ে অবৈধভাবে মার্কেট নির্মাণ হতে পারে না। এখানে মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয় জড়িত রয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির আশ্রয় প্রশয়ে সে এইসব দুর্নীতি লুটপাট করে যাচ্ছে। বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা মার্কেট বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন করেছে। এ নিয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেজারত ডিপুটি কালেক্টর (এনডিসি) খায়রুল ইসলাম বিদ্যালয়ে শিক্ষক অভিভাবক ও এলাকাবাসীদের নিয়ে গণশুনানী করেন। সবার মতামতের ভিত্তিতে তিনি একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রতিবেদনের আলোকে কোন ব্যবস্থা আর নেওয়া হয়নি। এছাড়াও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মার্কেট না করার জন্য নির্দেশনা দিয়ে একটি চিঠিও দিয়েছেন। এরপরও পুরোদমে চলছে মার্কেট নির্মাণের কাজ।
এদিকে টাঙ্গাইল দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসারও পাঁচতলা ভবন নির্মান করা হচ্ছে। সেখানেও বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান খান ফারুক সুপার মার্কেট ও একাডেমিক ভবন নামে মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। নিচতলায় ১১টি ও দোতলায় ১১টি মোট ২২টি দোকান নির্মান করা হয়েছে। প্রতি দোকান থেকে ১০ লাখ করে নিয়ে মাদ্রাসার তহবিলে জমা দিয়ে ওই টাকা দিয়েই মার্কেট নির্মাণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া প্রতি দোকান থেকে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ হাজার টাকা। দোকান বরাদ্দের নামে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সভাপতির পক্ষে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সোহরাব হোসেন বলেন, নিয়মতান্ত্রিকভাবে সব কিছু হয়েছে। এখানে অনিয়মের কোন সুযোগ নেই। সভাপতি আরও তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অনেক টাকা মাদ্রাসার মার্কেট নির্মাণে খরচ করেছেন।
টাঙ্গাইল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ব্যবস্থাপনা কমিটির রেজুলেশনের মাধ্যমে পৌরসভার অনুমোদন সাপেক্ষে বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে চারতলা একাডেমিক ভবন ও নিচতলায় মাকেট নির্মাণ করা হচ্ছে। ছাত্রীদের শ্রেনিকক্ষের অপ্রতুলতার কারণেই ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। মার্কেটের টাকা দিয়ে ভবনের নির্মাণের ব্যয় হচ্ছে। এখানে দুর্নীতি ও লুটপাটের কোন সুযোগ নেই।
অভিভাবক অ্যাডভোকেট আলিমুল মোর্শেদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচন ছাড়াই অবৈধভাবে সভাপতির পদ দখল করে একক আধিপত্য বিস্তার করে দুর্নীতি লুটপাট করে বিদ্যালয়টি ধ্বংস করে দিচ্ছে। উন্নয়নের নামে মার্কেট নির্মাণ করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পায়তারা চলছে। শিক্ষক, অভিভাবকসহ এলাকাবাসীর মতামতের তোয়াক্কা না করে শুধু লুটপাটের জন্যই বিদ্যালয়ে মার্কেট করা হচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত।
বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী এডভোকেট জিনিয়া বখ্শ বলেন, বিদ্যালয়ের জমির উপর কুচক্রীদের দৃষ্টি পড়েছে। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু অর্থ লিপ্সু রাজনীতিক। এরা মেয়েদের স্কুলে পাইকারি কাঁচাবাজার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। মার্কেট নির্মাণ বন্ধ ও সভাপতিকে তার পদ থেকে অপসারণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান খান ফারুক ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরব গিয়েছেন। এজন্য তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
টাঙ্গাইল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি কুদরত-ই-এলাহি খান বলেন, পৌরসভা ও জেলা পরিষদ তদন্ত করে মার্কেট নির্মাণের জন্য অনুমোদন দিয়েছেন। এখানে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি হচ্ছে না।
এদিকে বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) টাঙ্গাইল সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মুজিবুল আহসান বিদ্যালয়ে তদন্ত করতে আসেন। তিনি বলেন, এই বিদ্যালয়ের একটি মার্কেট নিমার্ণ করবে এজন্য আমি তদন্ত করতে এসেছি।
টাঙ্গাইল জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রেবেকা সুলতানা জানান, জেলা প্রশাসকের নির্দেশক্রমে আমি বিদ্যালয়ে পরিদর্শন করেছি। সেখানে শিক্ষক অভিভাবক, ও ছাত্রীদের সাথে আলোচনা হয়েছে। তিনি আরও জানান, আইনে রয়েছে বিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে দোকান বা মার্কেট নির্মাণ করা যাবে না। তারা বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে মার্কেট করছে। সভাপতি আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে মার্কেট করছে। কিন্তু ছাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি আগে ভাবতে হবে। ইতিমধ্যে মার্কেট নির্মাণ বন্ধে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম বলেন, মার্কেট নির্মাণের খবর পেয়ে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়েছিল। তিনি বিষয়টির খোঁজখবর রাখছেন। আমরাও যোগাযোগ করছি। আগে ছাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখতে হবে। আইন অনুযায়ী দ্রুতই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

২৩৬ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *