টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠ এখন মিনি ট্রাক-কাভার্ডভ্যান স্টান্ড

টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল সদর টাঙ্গাইল স্পেশাল লিড নিউজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥
কর্তৃপক্ষের উদাসিনতা ও অবহেলায় টাঙ্গাইলের শতাব্দী প্রাচীণ কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠটি দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। অবৈধভাবে বসানো মিনি ট্রাকস্ট্যান্ড, ট্রান্সপোর্ট ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের অধিক্যে মাঠটিতে ধর্মীয় কার্যাবলী বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া বর্তমানে কাঁচাবাজার, ফাস্টফুড, চা-স্টল, পুরি-সিঙ্গারা, শরবতের দোকান, বাঁশের বাজার, কাঁচাবাজারের সকল আবর্জনা ফেলাসহ পয়নিষ্কাসনের স্থানে পরিণত হয়েছে কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠ। রক্ষক হয়ে ভক্ষকের দায়িত্ব পালন করছে টাঙ্গাইল পৌরসভা। যে পৌরসভার দায়িত্ব সঠিক ও সুন্দরভাবে কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠ রক্ষনাবেক্ষনের। সেই পৌর কর্তৃপক্ষই এসবের জন্য দায়ি বলে জেলার সুশীল সমাজ বলছেন।
জানা গেছে, বিগত ১৯০৫ সালে শহরের প্রাণকেন্দ্রে ৬ একর জায়গার উপর স্থাপিত হয় টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠ। জায়গাটি ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত। সরকারের পক্ষে মাঠের মালিক জেলা প্রশাসক। কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে থাকে টাঙ্গাইল পৌরসভা। প্রতিবছর এই মাঠে মুসলমানদের দুটি বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাসহ সারাবছর নানা ধর্মীয় কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রতিবছর অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এই মাঠে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এছাড়া ঈদগাঁ মাঠ ঘেষে পশ্চিমে রয়েছে মারকাস মসজিদ ও মাদ্রাসা। যেখানে প্রতিনিয়ত নামাজ কালাম আদায় করছেন ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিরা। এছাড়া এই মসজিদে তাবলিক জামাতের দেশ-বিদেশের বহু মুসুল্লিরা আসেন। বর্তমানে ঈদগাঁ মাঠটি সঙ্কুচিত হয়ে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, দীর্ঘ ১১৮ বছরের পুরাতন কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠের ৬ একর জায়গার মূল ফটকের কাছে উত্তর দিকে বাউন্ডারি দেয়াল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ৮টি চায়ের দোকান, একটি যৌনশক্তি বর্ধক শরবতের দোকান, দুটি ফাস্টফুড, দুটি পুরি-সিঙ্গারার দোকান। কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠের মাঝখানে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড বসিয়ে সারি সারি শ’ শ’ মিনি ট্রাক রাখা হয়েছে। মিনিট্রাক স্ট্যান্ডের চাঁদা আদায়ের জন্য অস্থায়ী ছাউনি তৈরি করা হয়েছে। অস্থায়ী ছাউনিতে বসে দুজন স্টাফ নির্দিষ্ট রশিদের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করছেন। এর পশ্চিম দিকে বসানো হয়েছে ট্রান্সপোর্ট ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান স্ট্যান্ড। সেখানে শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করতো।
সোমবার (১৬ অক্টোবর) সকালে দেখা যায়, বড়-বড় কাভার্ড ভ্যান থেকে নামানো হচ্ছে হরেক রকমের পণ্য। মাঠে খেলতে আসা বিভিন্ন এলাকার শিশু-কিশোরদের ব্যাট-বল হাতে নিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ৮-১০টি ফিটনেস ক্লাবের সদস্যদের শরীর চর্চা ও খেলাধুলার জায়গা অবশিষ্ট নেই। মাঠের পূর্ব পাশে পার্কের বাজারের দেয়াল ঘেষে পৌরসভার বিভিন্ন অংশ থেকে সংগ্রহ করা কাঁচাবাজারের সকল আবর্জনা ও বর্জ্য রাখা হয়েছে। দেয়াল ঘেষেই বাজারের ও ট্রাকস্ট্যান্ডের লোকজন পয়নিষ্কাসন করছেন। এদিকে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে ময়লা-আর্বজনা ও পয়নিষ্কাসন থেকে উৎকট দুর্গন্ধ বের হয়েছে। টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠের দক্ষিণ পাশের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে টাঙ্গাইলের একমাত্র বাঁশের বাজার। পুরো দক্ষিণ অংশ জুড়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের বাঁশ। এছাড়া দক্ষিণ অংশের সীমানা প্রাচীরের পাশে অবস্থিত শহরের অন্যতম পয়নিস্কাশন ড্রেনটি ময়লা-আর্বজনায় পূর্ণ হয়ে গেছে। ফলে পৌর এলাকার পশ্চিম অংশে পয়নিস্কাশন ব্যবস্থা এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠে মালবাহী ভারি ট্রাক চলাচলের কারণে মাটি-কাঁদায় একাকার হয়ে গেছে। ফলে মাঠটি ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ঈদগাঁ মাঠের বৃষ্টির পানি বের হওয়ার একমাত্র ড্রেনটি পৌরসভার ফেলা বর্জ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। পুরো ঈদগাঁ মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্লাস্টিকের কাপ, চা তৈরির ব্যবহৃত পাতি, দুটি ফাস্টফুডের দোকানের ব্যবহৃত ওয়ানটাইম প্লেট, গ্লাস, পলিথিন ও ব্যবহার করা টিস্যু পেপারসহ নানা বর্জ্য। এছাড়া ঈদগাঁ মাঠের পূর্বাংশ জুড়ে প্রতিদিন সকালে সবজির বাজার বসে থাকে। সবজি বাজারের বহুবিধ সবজির পরিত্যক্ত অংশ মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।
ভোর সকালে ঈদগাঁ মাঠে ক্রিকেট অনুশীলন করতে আসা শিক্ষার্থী সোয়েব, ছায়েম, মেহেদী, তমাল, আবীর, শাহীনরা জানায়, প্রতি শুক্রবার ছাড়াও বন্ধের দিন তারা এখানে খেলাধুলা করার জন্য আসেন। কিন্তু এখন এসে তারা দেখতে পান- তাদের খেলার জায়গায় বিভিন্ন ছোট-বড় ট্রাক রাখা হয়েছে। সপ্তাহে মাত্র একদিন তারা খেলার সুযোগ পেলেও অবৈধভাবে ট্রাকস্ট্যান্ড গড়ে উঠায় শিক্ষার্থীরা খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ কেন্দ্রীক গড়ে ওঠা এভারগ্রীন ফিটনেস ক্লাবের সমন্বয়ক সৈয়দ নাজমুল হোসেন জানান, ঈদগাঁ মাঠকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন সকালে ৮-১০টি ফিটনেস ক্লাবের শতাধিক সদস্য মাঠে খেলাধুলা ও শরীরচর্চা করে থাকেন। এতোগুলো ফিটনেস ক্লাবের সদস্যদের জন্য ঈদগাঁ মাঠ এমনিতেই অপ্রতুল। এরমধ্যে ‘মরার উপর খারাড় ঘা’য়ের মতো গড়ে উঠেছে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড। ফলে ভোর সকালে খেলতে আসা বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষসহ স্বাস্থ্য সচেতন লোকদের জন্য এটা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি অবিলম্বে ট্রাকস্ট্যান্ডটি উচ্ছেদ করে ঈদগাঁ মাঠের পবিত্রতা রক্ষার জোর দাবি জানান।
টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠে কথা হয় স্থানীয় রাসেল খান, আনিছুর রহমান, আব্দুল লতিফ, শরিফুল ইসলাম ভূইয়া, মশিউর রহমান, হাদিউজ্জামান সোহেল, ছাদেক ইসলাম, জামিল সিদ্দিকী, আব্দুল মজিদ সুমন, আনোয়ার হোসেন, হিমেলসহ আরও অনেকের সঙ্গে। তারা ক্ষোভের সাথে জানায়, মুসলমানদের জন্য ঈদগাঁ মাঠ একটি পবিত্র স্থান। কয়েক বছর ধরে এখানে স্থাপন করা হয়েছে- চায়ের দোকান, শরবতের দোকান, ফাস্টফুড, সিঙ্গারা-পুরির দোকান। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ঈদগাঁ মাঠে মিনি ট্রাকস্ট্যান্ড বসানো হয়েছে। প্রতিদিন ট্রান্সপোর্টের মালামাল নামানোর স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারি ট্রাক চলাচলের কারণে ইতোমধ্যে ঈদগাঁ মাঠ অসমতল ও কর্দমাক্ত হয়ে গেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠ দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। তারা আরও জানায়, ঈদগাঁ মাঠটি সংস্কার করার উদ্যোগের কথা বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা অবিলম্বে কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠ থেকে ট্রাকস্ট্যান্ডসহ সকল ধরনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার দাবি করেন।
ঈদগাঁ মাঠে গড়ে ওঠা মিনি ট্রাকস্ট্যান্ডের নেতৃত্বদানকারী শ্রমিক নেতা হোসেন আলী ও রুবেল মিয়া জানান, শহরের স্টেডিয়াম পুকুরের সামনে থেকে ট্রাকস্ট্যান্ডটি উচ্ছেদ করার পর তারা পৌর মেয়রের সঙ্গে কথা বলে অস্থায়ীভাবে ঈদগাঁ মাঠে ট্রাকস্ট্যান্ডটি স্থাপন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র সিরাজুল হক আলমগীর জানান, বিভাগীয় কমিশনার গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে জেলা ক্রীড়া সংস্থার পুকুরের সামনে থেকে ট্রাকস্ট্যান্ডটি সরিয়ে ঈদগাঁ মাঠে অস্থায়ী ভিত্তিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। কোন অবস্থাতেই ঈদগাঁ মাঠে ট্রাকস্ট্যান্ডসহ কোন ধরনের দোকান করার সুযোগ নেই। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে টাঙ্গাইল পৌরসভা টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠ সংস্কারের কাজ শুরু করবে।
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম জানান, কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠে ট্রাকস্ট্যান্ড স্থাপন করার কোন ধরনের অনুমতি দেওয়া হয়নি। যদি কেউ বিনা অনুমতিতে ট্রাকস্ট্যান্ড বসিয়ে থাকে। তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সদর আসনের সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত নন। কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব টাঙ্গাইল পৌরসভার। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে তিনি দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেন।

 

২০২ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *