টাঙ্গাইলে নৌকার জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাইয়ে গোপন মাঠ জরিপ

টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল স্পেশাল রাজনীতি লিড নিউজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন ধরনের ঝুঁকি নিতে চায় না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। টানা চতুর্থবারের মতো বিজয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ইতোমধ্যেই নৌকার জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাইয়ে মাঠ জরিপের কাজ শুরু করেছে দলটি। আর এ গোপন মাঠ জরিপের কাজ স্বয়ং মনিটরিং করছেন দলটির প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ ধরে নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিটি আসনেই এবার শক্তিশালী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবে। তবে গত টানা তিন মেয়াদে বিতর্কিত, জনবিচ্ছিন্ন, বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদদদাতা এবং দ্বন্দ্ব-কোন্দলে জড়িত মন্ত্রী-এমপিদের আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেক্ষেত্রে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অর্ধ শতাধিক বিতর্কিত-জনবিচ্ছিন্ন মন্ত্রী-এমপির কপাল পুড়বে, সেসব আসনে এবার নতুন মুখ দেখা যেতে পারে বলেই মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। সব বাধা কাটিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিকেই এখন চোখ আওয়ামী লীগের। সরকারকে চাপে রেখে দাবি আদায়ে নির্বাচনে না আসার কথা মুখে বললেও আওয়ামী লীগ নিশ্চিত শেষ পর্যন্ত দলের অস্তিত্ব রক্ষায় নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং দেশ-বিদেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হোক সেটাও প্রত্যাশা দলটির হাইকমান্ডের। আর সে কারণে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনরূপ ঝুঁকি নেবে না আওয়ামী লীগ। রাজপথের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তি ইমেজ দিয়ে পরাজিত করতে পারে এমন যোগ্য ও পরীক্ষিত নেতাদের হাতেই এবার নৌকা প্রতীক তুলে দিতে চান দলটি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের ৩শ’ আসনের দলীয় মন্ত্রী-এমপিদের ব্যক্তিগত প্রোফাইল এখন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার হাতে। গত টানা তিন মেয়াদে মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচনী এলাকায় কতটা জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছে, বিতর্কিত-জনবিচ্ছিন্ন কিংবা দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করে বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদদদাতা এবং প্রভাব খাটিয়ে ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে পারিবারিক বলয় তৈরি করা এবং অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী-এমপিদের সার্বিক কর্মকা-ের পুরো ফিরিস্তি রয়েছে দলীয় প্রধানের হাতে। এদিক বিবেচনায় রেখে আগামী নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে জনপ্রিয়-ত্যাগী এবং বিজয়ী হওয়ার মতো প্রার্থীদের এবার দলীয় প্রতীক নৌকা তুলে দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঠ জরিপসহ আগামী নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন। বৈঠকে অংশ নেয়া একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করার কোন দায়িত্ব তিনি নেবেন না। যাঁরা প্রার্থী হবেন, তাদের নিজ যোগ্যতায় এবং নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের মন জয় করেই বিজয়ী হয়ে আসতে হবে। সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন হবে চ্যালেঞ্জিং। সে কারণে দলের প্রার্থী বাছাইয়ে সারাদেশে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতারাই আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাবেন।
দলের নীতিনির্ধারক নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে কোন ধরনের ঝুঁকি নেবে না আওয়ামী লীগ। আর অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় এবার মনোনয়নের ক্ষেত্রে নেত্রী (শেখ হাসিনা) খুবই সিরিয়াস। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শক্তভাবেই বলেছেন, সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন তিনি দেখতে চান। এ জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকেই দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে বিতর্কিত ও জনবিচ্ছিন্ন বেশ ক’জন মন্ত্রী-এমপি যে বাদ পড়বেন, এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এরইমধ্যে দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেবিলে অনেক দলীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সংগঠনবিরোধী নানামুখী অভিযোগ জমা হয়েছে। এসব অভিযোগের মধ্যে দলের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পাওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, ‘এমপি বলয়’ সৃষ্টি, বিদ্রোহীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে দলের অভ্যন্তরে কোন্দল সৃষ্টির বিস্তর অভিযোগ জমা পড়েছে আওয়ামী লীগ সভাপতির দফতরে।
এদিকে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক টিমের নেতারাও এসব বিষয়ে দলীয় সংসদ সদস্যদের বিষয়ে মৌখিকসহ প্রতিবেদন আকারে লিখিতভাবে নানামুখী অভিযোগ জমা দিয়েছেন। তৃণমূলের ওই সকল অভিযোগপত্র এখন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার টেবিলে। অভিযোগগুলো সত্যতা নিরুপণে গোপনে মাঠ থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজও শুরু হয়েছে। এতে করে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ফেঁসে যেতে পারেন দলের অনেক প্রভাবশালী সংসদ সদস্য-মন্ত্রীরা।
এ বিষয়ে দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানান, আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা এই দলটিকে এত সময় ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যে দলটির সব তিনি চেনেন, ভাল চেনেন, ভাল বোঝেন। দলের মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচনী এলাকায় কে কী করছেন, সবই রয়েছে তার নখদর্পণে। সে কারণেই তিনি দল হোক বা নির্বাচনে মনোনয়ন হোক; সময় উপযোগী করে সাজিয়ে থাকেন এবারও সেভাবেই সাজাবেন। তারা আরও বলেন, যাদের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে তাদের ব্যাপারে জরিপ চলছে। সবার আমলনামা নেত্রীর কাছে আছে। বারবার মাঠ জরিপ করে তিনি আমলনামা নিচ্ছেন। সেই আমালনামা অনুসারে কোন নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে কেউ রেহাই পাবেন না। সে যত বড় নেতাই হোক, আর যত বড় যেই হোক- কেউ এবার রেহাই পাবেন না।
দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে দলের নির্বাচনী ইশতেহার ও ঘোষণাপত্র তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট নেতাদের। এছাড়া দলীয় সভাপতি নিজস্ব জরিপ টিম, বিভিন্ন সংস্থা দিয়ে যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ে মাঠ জরিপ চালিয়ে যাচ্ছেন। দলকে নির্বাচনমুখী করে তুলতে তৃণমূলে সম্মেলনের মাধ্যমে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দল গুছিয়ে নতুন উদ্যোমে আগামী নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের জনগণের মন জয় করে বিজয় আনতে চায় দলটি। তাই দলের দুর্নীতিবাজ, বিতর্কিত, দুর্নীতিবাজ, দলীয় কোন্দলে জড়িত নেতা-মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে সৎ, ত্যাগী ও দক্ষ নেতাদের নিয়ে দল সাজাচ্ছে আওয়ামী লীগ। জানা গেছে, আগামী নির্বাচনের দেড় বছরেরও বেশি সময় বাকি থাকলেও এতটুকু সময় নষ্ট করতে চায় না আওয়ামী লীগ। নির্বাচনকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিদেশীদেরও চাপ বাড়ছে। এসব দিক লক্ষ্য রেখে বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে এবার নির্বাচনী এলাকায় ভোটারদের কাছে অধিক জনপ্রিয়, ত্যাগী পরীক্ষিত নেতাদের হাতে নৌকা প্রতীক তুলে দিতে চান দলটির হাইকমান্ড। এজন্য সারাদেশে ৩০০ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তাদের আমলনামা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দু’ধরনের প্রার্থী তালিকা তৈরি করছে ক্ষমতাসীন দলটি। বিএনপি নির্বাচনে এলে ১৪ দলীয় জোটের ব্যানারেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে তারা। পাশাপাশি মহাজোটের নামে না হলেও সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গেও অঘোষিত সমঝোতার মাধ্যমে আসন ভাগাভাগি করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে জোটের শরিকদের কোন কোন আসন ছেড়ে দিতে হতে পারে, সেসব আসনে জোটের প্রার্থীদের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মতো পরিবেশ রয়েছে কি না- এসবও গোপন জরিপের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত তৈরি করে প্রার্থী তালিকা তৈরি করবে আওয়ামী লীগ। আর শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে না এলে আওয়ামী লীগ ১৪ দলকে নিয়ে নির্বাচনে যাবে, সেক্ষেত্রে জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো আলাদাভাবে নির্বাচন করবে। তেমনি হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও আরেকটি পৃথক প্রার্থী তালিকা আগে থেকেই তৈরি করার কাজে হাত দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি।
দলটির সিনিয়র নেতারা বলেন, আমাদের নেত্রী (শেখ হাসিনা) রাজনৈতিকভাবে দক্ষ এবং বিচক্ষণ। তিনি ৪২ বছর আওয়ামী লীগের হাল ধরে আছেন। আমাদের নেত্রী তো সব ধরনের নেতাকেই চেনেন, সব ধরনের প্রার্থীকেই তিনি চেনেন। গোটা বাংলাদেশ তার নখদর্পণে। তাকে আলাদাভাবে কোন প্রস্তুতি নিতে হয় না। তিনি সুযোগমতোই বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। কেননা সারা বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতির হালচাল তার মুখস্থ। দ্বাদশ নির্বাচনেও তিনি যুৎসই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন। আগামী নির্বাচনটা একটি চ্যালেঞ্জিং নির্বাচন। সে কারণে নেত্রী হিসাব-নিকাশ করেই যোগ্য প্রার্থীকেই মনোনয়ন দেবেন।

৩৩৫ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *