মির্জাপুরে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার মন্ডপে আসবেন দেশি-বিদেশী অতিথি

টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল স্পেশাল বিনোদন মির্জাপুর লিড নিউজ

স্টাফ রিপোর্টার, মির্জাপুর ॥
প্রতিবছরের মতো এবারও দেশি-বিদেশি অতিথিদের জন্য প্রস্তুত হয়েছে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার এশিয়াখ্যাত দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার বাড়ির মন্ডপ। এবারও দেশি-বিদেশি অতিথিরা পূজা দেখতে এই মন্ডপে আসবেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। শুক্রবার রাত আটটায় দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে পূজা-অর্চনা শুরু করবেন ভক্তরা। এ উপজেলার সবচেয়ে বড় পূজামন্ডপ দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার বাড়ির মন্ডপ।

বুধবার (১৮ অক্টোবর) বিকেলে দেখা যায়, লৌহজং নদী ঘেষা মির্জাপুর গ্রামে পূজার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত মন্ডপের প্রতিমা। পাশেই নদীতে থাকা একটি বজরা ও একটি ডিঙ্গি রং দিয়ে সাজানো হয়েছে। কাঠ ও বাঁশ দিয়ে বানানো হচ্ছে সিঁড়ি। অতিথিরা কুমুুদিনী কমপ্লেক্র্্ের পৌছানোর পর বজরা ও ডিঙ্গি নৌকায় নদী পার হয়ে ওই সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে যাবেন রণদা প্রসাদ সাহার পুজামন্ডপে।
এলাকাবাসী জানান, তোরণ নেই, নেই আলোজসজ্জা। প্রতিমা ও মন্ডপটিও সাদামাটা। তবু সাদামাটা এই মন্ডপটি দুর্গোৎসবের সময় এখনও মির্জাপুর তথা টাঙ্গাইলের মূল আকর্ষণ। রণদা প্রসাদ সাহার এই মন্ডপে ঠিক কবে থেকে পূজা শুরু হয়েছ, তার সঠিক তথ্য নেই। তবে এখানে পূজা-অর্চনা করাতে প্রায় ৩৫০ বছরের ঐতিহ্য রয়েছে।

মির্জাপুর গ্রামের লোকজন জানান, আগে এখানে সবাই ক্ষুদ্র পরিসরে পূজা করতেন। এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৪২ সাল থেকে রণদা প্রসাদ সাহা এখানে ধুমধাম পূজা শুরু করেন। দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা না থাকলেও এখনও মন্ডপটিতে ধুমধামেই চলছে পূজা। তবে ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি রণদার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা জন্মের পর পূজার উৎসব আরও বেড়ে যায়। প্রতিবছর পূজার সময় রাতে পাঁচ থেকে সাত দিনব্যাপী যাত্রাপালা হতো। এতে স্থানীয় ব্যক্তিরা ছাড়াও কলকাতার নাট্য কোম্পানির শিল্পীরা অভিনয় করতেন। যাত্রাপালা চলার সময় রণদার বাড়ির পশ্চিম পাশে আন্ধরা গ্রামের রসিক ভবনের পেছনের মাঠে লঙ্গরখানা খুলে প্রতিমা দর্শন ও যাত্রাপালা শুনতে আসা হাজারও মানুষকে পাঁচদিন খাওয়ানো হতো। পূজামন্ডপ ঘিরে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার মিলনমেলা হতো।

কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট্রের পরিচালক (শিক্ষা) একুশে পদক প্রাপ্ত প্রতিভা মুৎসুদ্দি বলেন, ৩শ বছরের ঐতিহ্য বহন করছে পূজামন্ডপটি। সাদামাটা পূজামন্ডপটি এখনো সারা দেশের আকর্ষণ। অন্যবারের মোত এবারও প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী ছাড়াও দেশি-বিদেশি অতিথিরা মন্ডপটিতে আসবেন পূজা দেখতে।
মির্জাপুর উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বিকাশ গোাস্বামী মধু ও সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সরকার হিতেষ চন্দ্র পুলক জানান, ১৯৫২ সাল থেকে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা মহাষ্টমীর দিনে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ করতেন। ষাট দশকের মাঝামাঝি সময়ে এই বস্ত্র বিতরণের সময় দুর্ঘটনা ঘটায় তিনি পরবর্তীতে এলাকার জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বস্ত্র বিতরণ করতেন বলে তারা জানান।

পূজার সময় ১২ জোড়া ঢাকি ঢাক বাজাতেন, আন্ধরা গ্রামের রশিক ভবনের পেছনে প্রায় ৬০ ফুট উঁচুতে তৈরি করা নহবতখানা থেকে সানাই বাজানো হতো। স্বাধীনতার পর নহবতখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। আট বছর আগে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে নহবতখানা। সেখানে পূজার সময় সানাই বাজানো হয়। এবারো সানাই বাজানো হবে। সেজন্য নহবতখানাটি রং করে প্রস্তুত করা হয়েছে।
দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার দুর্গাপূজা উপলক্ষে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি বাড়িতেই নায়ড়ী-ঝিয়াড়ীসহ আত্মীয়-স্বজনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠত বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন।
এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ৭মে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা নারায়নগঞ্জের বাসা থেকে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তার পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহা রবিকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। এরপর দানবীরের পূজামন্ডপের অনেক কিছুই আর নেই। দানবীরের পূজামন্ডপের সেই যাত্রাপালা আর হয় না। লঙ্গরখানাও বন্ধ রয়েছে। নহবতখানায় কলকাতা থেকে আনা সানাইয়ের ক্যাসেট বাজানো হতো। তবে এখনো পূজা দেখতে আসা অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়।

পুষ্টকামুরী গ্রামের বাসিন্দা মির্জাপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুর রহমান শহীদ জানান, দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার বাড়ির দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে এলাকার প্রতিটি বাড়িই আত্মীয়-স্বজনে ভরপুর থাকে। দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার পূজামন্ডপে শুধু মির্জাপুরের নয়, শারদীয় উৎসবে সারা দেশেই পূজারীদের কাছে এখনও মূল আর্কষণ বলে তিনি মন্তব্য করেন। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী সাদামাটা এই প্রতিমাটি দেখতে ভিড় জমান। এছাড়া দেশি-বিদেশি অতিথিদের ভিড়ও আগের মতোই রয়েছে।

ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ আবু সালেহ মাসুদ করিমের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, দুর্গা পূজা উপলক্ষে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সর্বদা সচেতন রয়েছে। এ বছর পৌরসভায় ৫০টি মন্ডপসহ ১৪টি ইউনিয়নে ২৪৩টি মন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হবে। মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাকিলা বিনতে মতিন বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গা পূজা সমাপ্ত করতে পূজা কমিটি ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে একাধিকবার সভা করা হয়েছে।

 

৩০৪ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *