স্টাফ রিপোর্টার, মির্জাপুর ॥
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ৮২ নং সাফর্তা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠের জমি দখলে নিতে বাঁশের বেড়া দিয়ে ও গাছ রোপন করে দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে গত ছয়দিন ধরে ওই স্কুল মাঠে খেলাধূলা বন্ধ রয়েছে। এ নিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। বিদ্যালয় মাঠে বাঁশের বেড়া তৈরি করেছেন বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও ওয়ার্শী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন খানের শ্বশুর আব্দুল মান্নান খান ওরফে ফারুক খান। আব্দুল মান্নান খান মনির হোসেন খানের আপন মামাও হন।
গ্রামের প্রবীন ব্যক্তিরা জানান, সাফর্তা গ্রামের ছেলে মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা লাভের জন্য ১৯৭০ সালে সাফর্তা গ্রামের বাসিন্দা বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক প্রয়াত এনআই খানের নেতৃত্বে গ্রামবাসী বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য ফজলুর রহমান খান ফারুক বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ ও ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। বিদ্যালয়টির নামে ২ নং খতিয়ানে ৫৭২ নং দাগে ১৫ শতাংশ ও ৫৭৩ নং দাগে ৫২ শতাংশ জমি রয়েছে। এনামুল হক খান ফরেস্টার সাফর্তা জনকল্যাণ সমিতির সভাপতি থাকাকালীন গ্রামের লোকজন বিদ্যালয়ের মাঠ বড় করতে সামনের ৪৩ শতাংশ জমি সমিতির নামে কিনে দেয়ার দাবি করেন। পরে তিনি জমির মালিক একই গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হালিম খানের সঙ্গে কথা বলে তাদের মধ্যে (১০৬ নং খতিয়ানের ৫৭৩ নং দাগের ৪৩ শতাংশ জমি) এওয়াজ (বিনিময়) দলিল করেন। পরে এনামুল হক খান ওই জমি জনকল্যাণ সমিতির নামে দিলেও তা বিদ্যালয়ের মাঠ হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে। হাল রেকর্ডে এওয়াজকৃত জমি আব্দুল হালিম খানের নামে রেকর্ড হয়। কিন্তু ওই রেকর্ডে দখল বিষয়ে অনুমতি সাফর্তা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া উয়ার্শী ইউনিয়ন ভূমি অফিসের খাতায় পরিবর্তনের সূত্র ও বিবরণে ৫৭৩ নং দাগে অনুমতি দং সাফর্তা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উল্লেখ রয়েছে। জমির মালিকানা দাবি করে আব্দুল হালিম খানের ছেলে আব্দুল মান্নান খান খাজনা দিতে এবং নামজারি করাতে গেলে এজন্য তা করাতে পারেননি। আব্দুল মান্নান খান ইতোপূর্বে একাধিকবার ওই জমিতে বাঁশের বেড়া দিয়ে দখলের চেষ্টা করেন। গ্রামের লোকজনের বাঁধার মুখে তা করতে পারেননি। এ নিয়ে প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান প্রয়াত আব্দুল্লাহ হেল সাফি একাধিকবার সালিশি বৈঠক করেন বলে জানা গেছে।
গত বুধবার (২৫ অক্টোবর) পুণরায় ওই বিদ্যালয় মাঠে বাঁশের বেড়া দেওয়া এবং গাছ রোপন করায় নতুন করে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। মাঠে সকল ধরনের খেলধূলা বন্ধ রয়েছে। এছাড়া এই মাঠে সকল ধরনের ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। তাও বন্ধ রয়েছে। এ নিয়ে গ্রামের লোকজনের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছে। যে কোন মুুহুর্তে বড় ধরণের সংঘাতের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
সাফর্তা জনকল্যাণ সমিতির ক্রিড়া সম্পাদক কাজল খান বলেন, বিগত ১৯৯৬ সালে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করেছেন। এ পর্যন্ত মাঠটি বিদ্যালয়ের জেনে আসছি। এখন একটি প্রিন্ট (রেকর্ড) পর্চা নিয়ে এসে জমির মালিকানা দাবি করে মাঠে বেড়া দেয়া হয়েছে। এতে খেলাধূলাসহ সকল ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ৫৫ বছর বয়সী ইউনুস খান বলেন, প্রয়াত এনআই খানের উদ্যোগে গ্রামে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্বাধীনতার পর বিদ্যালয়ের মাঠের জমি নিয়ে কোন বিরোধ হয়নি। গ্রামবাসী মাঠটি বিদ্যালয়েরই জেনে এসেছেন। দেলোয়ার হোসেন খান (৬৫) ও আব্দুর রউফ খান (৫৮) জানান, এওয়াজ দলিল মূলে জমির মালিক সাফর্তা জনকল্যাণ সমিতি হলেও মাঠটি বিদ্যালয়ের হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এই মাঠে প্রতিদিন দুই গ্রুপে অর্ধশত শিশু কিশোররা নানা ধরনের খেলাধূলা করে থাকে। বাঁশের বেড়া দেওয়ায় খেলাধূলা বন্ধ রয়েছে। সাফর্তা গ্রামের ৭০ বছর বয়সী মহর খান জানান, বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় নিজেরা বাঁশ কেটে ঘর তৈরি করেন। পরে ফজলুর রহমান খান ফারুক যখন এমপি হন তখন বিদ্যালয়টি সরকারি করে দেন। বিদ্যালয়ের মাঠে বাঁশের বেড়া দেওয়ায় গ্রামবাসীর মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বার গফুর খান মনা জানান, একটি প্রভাবশালী মহল বিদ্যালয়ের মাঠের জমি দখলের পায়তারা করছেন।
ওয়ার্শী ইউপির চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম মল্লিক জানান, মনির হোসেন গায়ের জোরে শ্বশুরকে দিয়ে এসব করাচ্ছেন। তিনি গ্রামের লোকজনের কোন অযুহাত মানেন না। মনিরের ছেলে-মেয়ে ওই বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে না। তারপরও প্রভাব খাটিয়ে বিদ্যালয়ের সভাপতি হয়েছেন।
আব্দুল মান্নান খানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, এওয়াজ দলিল বাতিল হওয়ায় বিদ্যালয়ের সামনের জমি আমার বাবার নামে রেকর্ড হয়েছে। দলিল বাতিল হওয়ার প্রমাণপত্র আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, সংগ্রহে নেই।
বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মনির হোসেন খান জানান, তার নানার সাথে এওয়াজ করা জনকল্যাণ সমিতির জমি বিদ্যালয়ের মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এওয়াজকৃত জমি বিক্রি করতে গিয়ে দেখা যায় এনামুল হক খান ফরেস্টার জমির দাগ নম্বর ভূল ব্যবহার করেছেন। এজন্য দুটি জমিই এনামুল হক খান নিয়ে নেয়। গ্রামবাসীকে নিয়ে ফয়সালার জন্য কয়েক দফায় বসা হয়। তখন গ্রামবাসী ১৬ শতাংশ জমি আমার শ্বশুরকে রাস্তার ধারে কিনে দেবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। দীর্ঘদিনেও তা দেয়া হয়নি। কিছু টাকা দিয়ে হলেও এর সমাধাণ করা দরকার বলে তিনি জানান।
বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা সানিয়া সুলতানা ও সাহিদা আক্তার জানান, প্রধান ও সহকারি প্রধান শিক্ষক না থাকায় মাঠে বাঁশের বেড়া দেওয়ার বিষয়ে কাউকে অবহিত করা হয়নি।
মির্জাপুর উপজেলা শিক্ষা অফিসার শরিফ উদ্দিন জানান, বিদ্যালয়ের জমিতে বাঁশের বেড়া দেয়ার বিষয়টি জানা নেই।
এ বিষয়ে মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাকিলা বিনতে মতিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের জমি দখলে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।