জাহিদ হাসান ॥
ঋতু তো এলোমেলো হয়েই গিয়েছে, ঋতুভিত্তিক উদ্ভিদ- বৈচিত্র্য ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। কখন যে কোন ফুল ফুটছে। কোন উদ্ভিদ কখন বেড়ে উঠছে, অবস্থান পরিবর্তন করছে তারও ঠিক নেই। নিকট অতীতে বাংলার ঋতু-বৈচিত্র্য মোহনীয় রূপে ধরা দিত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিটি ঋতু কাব্যের ধ্রুপদী ব্যঞ্জনায় কবিতা ও গানের নির্মাণশৈলীতে অপরূপ করে তুলেছেন। কবি জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতির কবিতাগুলো ঋতুর বহুমাত্রিক সুর হয়েছে।
ঋতুর উদ্ভিদ- বৈচিত্র্যে হালে শরতের শে^ত শুভ্রতার কাশবন ও কাশফুল ‘আগ্রাসী’ প্রজাতি হয়ে উঠছে। ছন গোত্রীয় এক ধরনের এই ঘাস দ্রুত উপনিবেশের ভূমিকা নিয়ে প্রায় সকল ঋতুতেই আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। কাশবন কাশফুলের উপনিবেশ নিয়ন্ত্রণহীন। শরতের ফুল হেমন্ত শীত অতিক্রম করে বসন্তেও থাকছে। গত ক’বছর ধরে তাই দেখা গেছে। এই মৌসুমেও একই। টাঙ্গােইল জেলার বিভিন্ন এলাকায় কাশফুল দেখা যাচ্ছে। যমুনা ও বাঙালির তীরে ও চরগ্রামে কাশফুল ফুটে আছে। লোকজন বলছেন এখন ফাল্গুন চৈত্র পর্যন্ত কাশফুল থাকে। নদী তীরে, চরাঞ্চলে, বিল ও ঝিলের ধারে, জলাভূমির আশেপাশে, পুকুরের ধারে কাশবন বেড়ে উঠে পাতা ফুল সুন্দরের উপমা হয়ে থাকে। কাশফুল এতটাই হালকা নরম তুলতুলে যেন ধবধবে সাদা বক পাখির পালক। তবে কাশবনের ভেতর দিয়ে হাঁটা তত সহজ নয়। সমতল ভূমির কাশবনের গাছের উচ্চতা তিন থেকে পাঁচফুট। এই বনে কাশকাঠি পড়ে থাকলে পায়ে বিঁধে যায়। নদী তীরে ও চরগ্রামের পলিমাটির আস্তরণে কাশ গাছের কা- ও মূল খুব সহজে সম্প্রসারিত হয়।
যে কারণে কোনো উদ্ভিদ বিজ্ঞানী কাশবন কাশকাঠি ও কাশফুলকে উপনিবেশবাদের সঙ্গে তুলনা করে আক্রমণাত্মক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাদের এই পর্যবেক্ষণ (অথবা ধারণা) যে একেবারেই অমূলক নয় তার প্রমাণ মিলছে। কোন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী বলছেন, কাশবনের এমন উপনিবেশ পূর্বেও ছিল। এখন হয়তো জলবায়ুর পরিবর্তনে কাশবন শরৎকালের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে থাকতে চাইছে না। বনাঞ্চল অবৈধভাবে সাফ-সুতরা করার পরও কাশবনের উপনিবেশ থামছে না। বাঁশ বাগান যেমন কোন গোত্রের এক ধরনের ঘাস প্রজাতি। কাশবন ও ফুল ছন গোত্রের ঘাস প্রজাতি। কাশের কাঠি অনেকটা বাঁশের কঞ্চির মতো। কাঠি কাঁচা অবস্থায় সবুজ। পেকে গেলে বাদামি ও মেটে রঙের। শুরুতে বাঁশের রং সবুজ। বেশি বয়সে রং পাল্টে হয় কাশকাঠির রঙের মতো। কাশফুল ও বাঁশ যে ঘাস প্রজাতি অনেকের কাছে তা অজানা। বর্তমান প্রজন্ম অবশ্য অনেক অ্যাডভান্সড। তারা বাঁশ ও কাশফুল কাঠিকে ঘাসই মনে করে। অতীতে বাঁশ ও বেড়ার ঘর (কুঁড়েঘর) নির্মাণে খড়, ছন ও কাশকাঠিতে ছাউনি (ছাদ) দেওয়া হতো। এখন সেই অবস্থা নেই। গ্রামে কোনো কুঁড়েঘর নেই। কাশকাঠির ব্যবহার কমেছে। কাশকাঠি ব্যবহার হচ্ছে পানের বরজের ছাউনিতে। ব্যবহার হয় জ¦ালানি হিসেবে।
কাশবন ও কাশফুল এখন আর নদী তীর, চরগ্রাম, বিল ঝিল ও জলাশয়ের মধ্যে নেই। আগ্রাসী ভূমিকায় দখল করছে শুকনো ভূমি, রুক্ষ ভূমি, উঁচু পাহাড়ি ভূমিতে। শরতের পর হেমন্ত শীত হয়ে বসন্তেও থাকছে। তবে পাহাড়ি এলাকায় ভিন্ন প্রজাতিরও কাশবন আছে। যেগুলো ঘন এবং অনেকটা উঁচু। ওই কাশপাতার ফুল বড় পাখির পালকের মতো। কিছুটা শক্ত। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীগণ বলছেন, সাধারণ কাশবনের মতো সমগোত্রীয় উদ্ভিদ আছে। যা অনেকটা কাশবনের মতো। পুরাণে এই কাশবনকে বলা হয়েছে কুশ প্রজাতি বা জাতকের উদ্ভিদ। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে এই কুশ জাতকের কথা বলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্যে কুশ জাতকের কাহিনী বর্ণনা করা হয়।
গল্পে বলা হয়, শে^ত শুভ্র কাশফুল শুভ কাজের প্রতীক। শান্তির বারতা এনে দেয়। এই ফুল মনের কালিমা দূর করে। এর শুভ্রতায় ভয়ভীতি দূর হয়। বিভূতিভূষণ মজুমদার ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে কাশফুল ও কাশবনের বর্ণনা করেছেন। বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাস অবলম্বনে যে ছবি নির্মাণ করেছেন সেখানে বাংলার ঐতিহ্যের কাশবনের চিত্রায়ন অপূর্ব। কাশবনের ভেতর দিয়ে কাহিনীর কিশোর-কিশোরী অপু ও দুর্গা চরিত্রের ছুটোছুটি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য তুলে ধরে। ঋতু-বৈচিত্র্যের এই কাশবন কাশফুল আরও বৈচিত্র্য এনেছে সময়ের পরেও অনেকটা সময় থেকে।