স্টাফ রিপোর্টার ॥
টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলায় কৃষিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছেন হাবিব খান নামের এক তরুণ উদ্যোক্তা। তার বাড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের কালিয়ানপাড়া গ্রামে। হাবিব খানের বাড়ির পাশে ১২ একর জমির ওপর গড়ে তুলেছেন নিজস্ব কৃষি বাগান। তার বাগানের নাম দিয়েছেন সমন্বিত ‘খান এগ্রো’ কৃষি বাগান। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে লালমাটিতে চাষ করছেন ফিলিপাইনের কালো আখ, টপ লেডি পেঁপে ও রঙিন সাগর কলা। এছাড়া এবার পরীক্ষামূলকভাবে চাষ শুরু করেছেন উচ্চ ফলনশীল বারোমাসি সজিনা। এতে চাকরি ছেড়ে আসা হাবিব খান এক বছরে প্রায় ১৫ লাখ টাকা আয়ের সম্ভাবনা দেখছেন। হাবিব খানের বাগানে কাজ করে স্থানীয়রা আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা অর্জন করতে পারছেন। হাবিব খানের কৃষি বাগান ওই গ্রামের চিত্র পরিবর্তন করে দিয়েছে। তাঁর সাফল্য দেখে অনেকেই ঝুঁকছেন কৃষির দিকে। এতে অনেকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা হাবিব খান বলেন, বিগত ২০১৭ সালে এমবিএ শেষ করে একটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। সেখানে পাঁচ বছর চাকরি করার পর আর ভালো লাগছিল না। আমার বন্দি জীবন একঘেয়েমি হয়ে উঠে। আমি যেহেতু কৃষকের সন্তান তাই কৃষিতে চিন্তা-ভাবনা থেকে চাকরি ছেড়ে দেই। বিগত ২০২২ সালে চাকরি ছেড়ে এসে কৃষি কাজে যুক্ত হই। বাড়িতে ফিরে বিভিন্ন লোকজনের সাথে পরামর্শ ও ইউটিউব ঘেঁটে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে আমি ফিলিপাইন জাতের উচ্চ ফলনশীল কালো আখ চাষ শুরু করি। এই আখটা খেতে অনেক সুস্বাদু ও বাজারে এর চাহিদা আনেক বেশি। আমার এলাকায় গড়ে তুলেছি সমন্বিত ‘খান এগ্রো’ কৃষি বাগান। এখন আমার ‘খান এগ্রো’ কৃষি খামারে প্রতিদিন কাজ করেন প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক। তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে দেড় একর জমিতে ফিলিপাইনের কালো জাতের আখের (ব্ল্যাক সুগার-কেইন) ১০ হাজার চারা রোপণ করেছি। প্রতি চারায় চারটি করে আখ হলেও ৪০ হাজার আখ বিক্রি করা যাবে। এতে গত ছয় মাসে খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা। আগামী দুই মাসে আরও দেড় লাখ টাকা খরচ হবে। আখ বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬ লাখ টাকা।
সরেজমিনে দেখা যায়, আখগুলো দেশিয় প্রজাতির আখের তুলনায় বেশি লম্বা। গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত পুরো। ২-৩ মাস পরেই আখ বিক্রি করতে পারবেন। বাগানের চলাচলের রাস্তার দুই ধারে লাগানো ফিলিপাইনের কালো জাতের আখ এখন তার বাগানে শোভা পাচ্ছে। আখ লম্বায় বড় হওয়ায় যেন ভেঙে না যায় সে জন্য বাঁশ, সুতা দিয়ে মাচা তৈরি করে আটকে রাখা হয়েছে।
হাবিব খান আরও বলেন, সেই সঙ্গে সাড়ে ৩ একর জমিতে ৩ হাজার রঙিন সাগর কলা চাষে খরচ হয়েছে ৮ লাখ টাকা। বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা। টপ লেডি জাতের উচ্চ ফলনশীল পেঁপে ১ একর জমিতে ১০০০ হাজার চারা রোপন করেছি। গত বছরও আমি ২ হাজার পেঁপে গাছ আবাদ করে উৎপাদন ব্যায়ের চেয়ে দ্বিগুণ লাভ পেয়ে ছিলাম। এ বছর পেঁপেতে এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৪ লাখ টাকা। এর বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ লাখ টাকা। আগামী বছরগুলোতে লাভ দ্বিগুণ হবে আশা করছি। পরবর্তীতে এর পরিধি আরও বাড়ানো হবে। এছাড়াও এবার পরীক্ষামূলকভাবে উচ্চ ফলনশীল বারোমাসি সজিনার আবাদও করেছেন হাবিব খান। চাকরির পিছনে না ছুটে কৃষিতে বেকার যুবকরা যদি লেগে পরেন তাহলে দেশে বেকারত্ব কমে যাবে। কৃষি বিভাগ থেকে যদি আরও বেশি সহযোগিতা করা হয় তাহলে কৃষিতে আরও আগ্রহ বাড়বে নতুন ও পুরাতন উদ্যোক্তাদের।
তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা অনিক খান বলেন, হাবিব খান পেঁপে, কলা, সজিনা ও আখ চাষ করছে। ফলনও ভালো হয়েছে। আমি পড়াশোনার পাশাপাশি হাবিব খানের সাথে আখ চাষ করেছি। আখের ভালো ফল হয়েছে। দামও ভালো পাবো। আমার মতো ছাত্ররা যদি কৃষি কাজে লেগে পড়ে তাহলে কেউ আর এ দেশে বেকার থাকবে না। কৃষি বিভাগ থেকে আরও বেশি সহযোগিতা করলে আমরা আরও বড় পরিসরে বাগান করতে পারবো। হাবিব খানের বাগানে কাজ করেন সবিজ মিয়া। তিনি বলেন, আমি হাবিব খানের বাগানে কাজ করি। হাবিব খান পেঁপেঁ, কলা, সজিনা, আখ চাষ করেছে। ভালো ফলন হয়েছে এ বাগানে। দেখে অনেক ভালো লাগে। এখানে কাজ করতেও ভালো লাগে। বেতনও ভালো পাচ্ছি। এ বেতনের টাকা দিয়ে আমরা সংসার ভালোভাবে চলে। রাজা মিয়া নামে আরেক শ্রমিক বলেন, হাবিব খান বাগান করে অনেক লাভবান হয়েছে। বাগানে কলা, পেঁপে, আখ ও সজিনা ভালো আবাদ হয়েছে। এ বাগানে তেমন কোন রোগ-বালাই নাই। এ বাগানে আমি দেখাশোনা করি। এখান থেকে যে টাকা পাই তা দিয়ে আমার সংসার চলে। হাবিবের বাগান দেখে অনেক বেকার যুবকরা আগ্রহ হয়ে বাগান করেছে। তারাও লাভবান হয়েছে। এভাবে বেকার যুবকরা কৃষির দিকে এগিয়ে আসলে বেকারত্ব কমে যাবে।
গজারিয়া ইউনিয়নের কৃষি সুপারভাইজার সালেহ আকরাম বলেন, তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা হাবিব খান তার সমন্বিত কৃষিভিত্তিক বাগানে ফিলিপাইনি জাতের ব্ল্যাক-সুগার-কেইন আখসহ বিভিন্ন প্রকার লাভজনক ফসল উৎপাদন করছে। বিভিন্ন সময় তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকি। আমি তার সমন্বিত কৃষি ভিত্তিক বাগানে উদ্যোগের সফলতা কামনা করি।
টাঙ্গাইলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আহসানুল বাশার বলেন, হাবিব খান পেঁপে, কলা, সজিনা, আখের বাগান গড়ে তুলেছে। এগুলো অনেক লাভজনক ফসল। এখান থেকে হাবিব খান বছরে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন। তরুণ ও শিক্ষিত যুবকেরা কৃষির দিকে ঝুঁকছেন তাদেরকে আমরা স্বাগত জানাই। দেশের কৃষির জন্য এটি ভালো উদ্যোগ। হাবিব খানে বাগান নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। হাবিব খানসহ কৃষি উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তি সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ।