এবারই প্রথম আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেন না সিদ্দিকী ও খান পরিবারের কেউ

কালিহাতী ঘাটাইল টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল স্পেশাল রাজনীতি লিড নিউজ

সাদ্দাম ইমন ॥
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইলের বহুল আলোচিত সিদ্দিকী ও খান পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। স্বাধীনতার পর দেশে ১১ বার জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে ১১ বার অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের কোন না কোন বার টাঙ্গাইলের যে কোন একটি পরিবারের কেউ না কেউ আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইলের ৮টি আসনের কোন আসন থেকেই বহুল আলোচিত সিদ্দিকী ও খান পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। সংসদ নির্বাচনের আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতিক না পাওয়ায় দলীয় রাজনীতি থেকে প্রভাবশালী দুই পরিবারের বিদায় ঘন্টা বাজতে শুরু করেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
জানা গেছে, মহান স্বাধীনতার পর থেকে টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে মূলত: শহরের প্রভাবশালী সিদ্দিকী ও খান পরিবারকে কেন্দ্র করে। দীর্ঘ ৫২ বছরে নানা কারণে সিদ্দিকী ও খান পরিবার নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। বিগত ১৯৯৯ সালে সিদ্দিকী পরিবারের অন্যতম সদস্য বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম আওয়ামী লীগ ছেড়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নামে আলাদা দল গঠন করেন। এরপর থেকে সিদ্দিকী পরিবারের বড় ছেলে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগে থাকলেও পরিবারের অন্য সদস্যরা আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে যায়। কাদের সিদ্দিকী আলাদা দল গঠন করে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আদর্শিক পিতা মেনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের আদর্শ ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করলেও আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতীক গামছার মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সিদ্দিকী পরিবারের বড় ছেলে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য ও সরকারের মন্ত্রী থাকাবস্থায় নিউইয়র্কের একটি সভায় ইসলাম ধর্ম ও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে সমালোচিত হন। ইসলামপন্থী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রীত্ব, আওয়ামী লীগের দলীয় পদ হারান এবং সর্বশেষ জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন।
এ সুযোগে খান পরিবার টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র কান্ডারী হিসেবে আবির্ভুত হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকায় খান পরিবারের সদস্য সহিদুর রহমান খান মুক্তি টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র, আমানুর রহমান খান রানা ঘাটাইল-৩ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শুধুমাত্র লতিফ সিদ্দিকীর নির্বাচনী এলাকা কালিহাতী উপজেলা ব্যতিত প্রায় সর্বত্র খান পরিবারের অনুসারীরা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নির্বাচিত-মনোনীত হন। বিগত ২০১২ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদের সঙ্গে খান পরিবারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। খান পরিবার সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটায় বিগত ২০১৩ সালে। ওই বছরের (১৮ জানুয়ারি) পৌর এলাকায় কলেজপাড়া থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার তিন দিন পর তার স্ত্রী নাহার আহমেদ বাদী হয়ে সদর থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা দায়ের করেন। গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে জেলার আওয়ামী রাজনীতির অন্যতম প্রভাবশালী খান পরিবারের চার ভাই সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা, পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি, ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে।
অতি সম্প্রতি টাঙ্গাইলের আটটি আসনের মধ্যে চারটি আসনে বর্তমান সংসদ সদস্যদের আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয়নি। তাদের জায়গায় নতুন চারজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়া নেতাদের মধ্যে টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনের এমপি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের, টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের এমপি ও টাঙ্গাইলের আলোচিত খান পরিবারের আতাউর রহমান খান, টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন ও টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে নির্বাচিত হাসান ইমাম খান সোহেল হাজারি রয়েছেন।
নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের (৭ মার্চ)। সেই নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে খান পরিবারের প্রয়াত শামসুর রহমান খান শাজাহান, টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের (১৮ ফেব্রুয়ারি)। সেই নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে খান পরিবারের প্রয়াত শামসুর রহমান খান শাজাহান, টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে পরাজিত হন। তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৬ সালের (৭ মে)। সেই নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে খান পরিবারের প্রয়াত শামসুর রহমান খান শাজাহান, টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী জেলে থাকায় তার স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন। চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সালের (৩ মার্চ)। সেই নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে খান পরিবারের প্রয়াত শামসুর রহমান খান শাজাহান, টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে পরাজিত হন।
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের (২৭ ফেব্রুয়ারি)। সেই নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে খান পরিবারের প্রয়াত শামসুর রহমান খান শাজাহান, টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে পরাজিত হন। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের (১৫ ফেব্রুয়ারি)। এই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেনি। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের (১২ জুন)। সেই নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে খান পরিবারের প্রয়াত শামসুর রহমান খান শাজাহান দলীয় মনোনয়ন পেয়ে পরাজিত হন। এছাড়া টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসন থেকে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০১ সালের (১ অক্টোবর)। সেই নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে খান পরিবারের প্রয়াত শামসুর রহমান খান শাজাহান। টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে পরাজিত হন।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের (২৯ ডিসেম্বর)। সেই নির্বাচনে খান পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাননি। এদিকে টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে জয়লাভ করেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের (৫ জানুয়ারি)। সেই নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে খান পরিবারের আমানুর রহমান খান রানা দলীয় মনোনয়ন পেয়ে জয়লাভ করেন। তবে সেই নির্বাচনে সিদ্দিকী পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাননি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের (৩০ ডিসেম্বর)। সেই নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে খান পরিবারের আতাউর রহমান খান দলীয় মনোনয়ন পেয়ে জয়লাভ করেন। তবে সেই নির্বাচনে সিদ্দিকী পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাননি।
দলীয় সূত্র জানায়, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খান আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাননি। তিনি আলোচিত খান পরিবারের কর্তা ও সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত শামসুর রহমান খান শাজাহানের ভাই এবং আমানুর রহমান খান রানার পিতা। প্রয়াত শামসুর রহমান খান শাজাহান টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে ৭ বার আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। আর তার ভাতিজা আমানুর রহমান খান রানা বিগত ২০১২ সালে উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এবং ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন। আওয়ামী লীগের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যা মামলায় আমানুর রহমান খান রানা ও তার ভাইয়েরা অভিযুক্ত হওয়ার পর তারা আত্মগোপন করেন। বিগত ২০১৮ সালের নির্বাচনে আতাউর রহমান খান আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন।

 

 

 

 

৫৪১ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *