হাবিবুর রহমান, মধুপুর ॥
২০১৬ সালের কথা। কনকনে শীত। চার দিকে শনশন বাতাস। পাহাড়ি লাল মাটির জনপদ যেন আরো হাড় কাঁপানো শীত। রোদ আর কুয়াশার মাখামাখি। কুয়াশা শিশিরের আড়ালে সূর্যের লুকুচুরি। কোমল আলোক রশ্মি যেন কচি আনারসের পাতার উপর পড়ে চিকচিক করছে। একটু পরেই দেখা দিয়েছে সূর্যের নরম হাসি। এমনি দিনে একটি চাদর জড়িয়ে যোগ দিলেন প্রধান শিক্ষক হিসেবে। একদম অজপাড়াগাঁ। সুবিধা বঞ্চিত অবহেলিত শিশুদের একটি পাঠশালায়। শুধু অবহেলিত সুবিধা বঞ্চিতই নয়। কেউ অন্ধ। কেউ বধির। কেউ বিকলাঙ্গ। কেউ শ্রবন ও বাক প্রতিবন্ধী। কারো নাকে পানি ঝরছে। কারো চোখে ময়লা। লালা ঝরছে অবিরাম। এভাবে প্রতিটি শিক্ষার্থীই যেন এক একটা সমস্যার পাহাড়। পরিপাটি পোশাক পড়া অবস্থায় জড়িয়ে ধরে শিক্ষার্থীরা। কথা না বলতে পারা আকুতি যেন তাদের কে বার বার তাড়া করে। এমনি সব শিশুরা হলো বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বিদ্যালয়টির নাম আউশনারা বুদ্ধিপ্রবিন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়। আর এ বিদ্যালয়ের প্রধান হিসেবে যোগ দেন রাবেয়া নাসরিন। যোগদানের পর থেকে তার বিবেক তাড়িত করে। কিভাবে ওদের জন্য ভালো কিছু করা যায়। মানুষ করার নিরন্তর প্রচেষ্টা তাকে ঘুমের রাজ্যে ব্যাঘাত করতে শুরু করে। রাত জেগে ভাবেন বিদ্যালয়ে তাদের কিভাবে সহকর্মীদের নিয়ে পড়াবেন। পরিচালনা কমিটি শিক্ষক অভিভাবক এলাকাবাসীকে নিয়ে করেন কর্মপরিকল্পনা। পরিকল্পনা মতো এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা যেন প্রতিরোধ্য।
প্রধান শিক্ষক রাবেয়া নাসরিন ২০২৩ সালে উপজেলা ও টাঙ্গাইল জেলা পর্যায়ে সমাজ সেবায় বিশেষ অবদার রাখায় পেলেন শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা। শনিবার (৯ ডিসেম্বর) মধুপুর উপজেলা ও টাঙ্গাইল জেলায় বেগম রোকেয়া দিবসে শ্রেষ্ঠ জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ শীর্ষক প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা পান। তাকে শনিবার (৯ ডিসেম্বর) সকালে রোকেয়া দিবসে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম এ সম্মাননা প্রদান করেন। তার জন্ম মধুপুর উপজেলার কালামাঝি গ্রামে। তিনি আব্দুর রশিদ মন্ডল ও আনোয়ারা বেগমের কনিষ্ঠ সন্তান।
রাবেয়া নাসরিন টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার আলোকদিয়া ইউনিয়নের কালামাঝি গ্রামের এক সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তার পিতার নাম আঃ রশিদ মন্ডল এবং মাতা আনোয়ারা বেগমের কনিষ্ঠ সন্তন তিনি। তিনি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স ও বিশেষ শিক্ষা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ থেকে বিএসএড ডিগ্রি পাশ করেন। বর্তমানে এমএসএড কোর্সে অধ্যয়নরত।
জানা যায়, ২০১৬ সালে সুইড বাংলাদেশ উদ্বেগে সুবিধা বঞ্চিত অবহেলিত বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য প্র্রতষ্ঠা করা হয় আউশনারা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়। অসহায় বুদ্ধি প্রতিবন্ধী অবহেলিত বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের খুব কাছে থেকে মায়ের সেবায় প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব করে এবং শিক্ষকতার মতো মহান কর্ম জীবন চালিয়ে যেতে থাকেন।
শুন্য থেকে যাত্রা করা স্কুলের শুরু করেন। সরকারি ভাবে এমপিও স্বীকৃতি না থাকায় স্কুল পরিচালনা করার জন্য অর্থিক যোগান তিনি নিজে যতটুকু পেরেছেন দিয়েছেন। বাকিটা সমাজের বৃত্তশালী,ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হণ্যে হয়ে ছুটেছেন। ছাত্র ছাত্রীদের ড্রেস, শিক্ষা উপকরন, দুপুরের খাবার ইত্যাদি ব্যয় মেটাতে স্কুলের শিক্ষক কর্মচারীদের নিয়ে দিনরাত নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় চেয়ারম্যান ও উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার সহযোগীতায় ১২০ জন প্রতিবন্ধী ছাত্র ছাত্রীর ভাতার ব্যবস্থা, উপজেলা প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও শিশুদের জন্য সহায়ক উপকরণ, বিনামূল্য ঔষধ বিতরণ, ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল ক্যাম্প, শীতবস্র বিতরণ, কর্মমুখী শিক্ষা,বিবাহ ও কর্মসংস্থানে সুযোগ তৈরির মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসনের মতো আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে তিনি সমাজের সর্বস্তরের মানুষদের অংশ গ্রহন নিশ্চিত করতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সহকারী কমিশনার(ভূমি), সমাজ সেবা কর্মকতা, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা,ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, বিভিন্ন এনজিও, সমাজকর্মী সহ সমাজের সচেতন মানুষদের কে তার কাজের সাথে সম্পৃক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন । অভিভাবক সমাবেশ, উপজেলা প্রসাশনের কর্মকর্তাদের নিয়ে সচেতনতা মূলক সভা করে প্রতিবন্ধী সন্তানদের পরিবারের বোঝা মনে না করার জন্য পিতামাতা ও সমাজ তাদেরকে বোঝা না মনে করার জন্য ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা অব্যাহ রেখে যাচ্ছেন। প্রতিবন্ধী শিশুদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে তিনি সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন। ফলে স্কুলটি পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা এবং সংস্কৃতি চর্চায়ও সবার নজরকাড়ে। ২০১৮ সালে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক স্পেশাল অলিম্পিকে বিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র একাধিক ক্যটাগরিতে স্বর্ণ পদক সহ আরো অনান্য পদক লাভ করে।
তিনি আরো জানান, দীর্ঘ ৮ বৎসর যাবত বিনা বেতনে আসহায় প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক শিশুদেরকে মাতৃস্নেহে পড়া লেখার পাশাপাশি সমাজের স্বাভাবিক শিশুদের জীবনমান পরিচালনার কৌশলরপ্ত করতে তিনি প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় সমন্বয় পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ন সাধারন সম্পাদক, প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় সমন্বয় পরিষদ টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সহ ডিজএ্যবল পিপলস ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সারা দেশে ১৭শ র অধিক বিশেষ শিক্ষা বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি ও এমপিও দাবিতে জোরালো ভুমিকা পালন করে যাচ্ছেন। এসব তথ্য রাবে নাসরিনের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
একজন সংগ্রামী আত্মপ্রত্যয়ী নারীর প্রতীকী নাম রাবেয়া নাসরিন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে ও ক্ষমতায়নে কেবল নিজের অদম্য ইচ্ছাকে সম্বল করে চরম প্রতিকূলতাকে জয় করে তৃণমূল থেকে সবার অলক্ষ্যে সমাজে নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন। প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিবারের এক আস্হা ও ভরসার প্রতীক তিনি অসহায় প্রতিবন্ধীদের জন্য তিনি একজন বাতিঘর হিসেবে জয়িতা সম্মান পেলেন । এ সম্মাননা তার কাজের গতিকে আরো বেগ ও সৃষ্টিশীল করবে এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।