সাদ্দাম ইমন ॥
বাঙালির পৌষ শুরু হয়ে গেছে। আর পৌষ শুরু মানে, পার্বণেরও শুরু। গ্রামের ঘরে-ঘরে এখন চলছে পিঠাপুলি পায়েসের আয়োজন। ঐহিত্যবাহী নানা উৎসব অনুষ্ঠান আয়োজনেরও সময় এটা। রবীন্দ্রনাথ তাই বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে লিখেছেন, ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আয় আয় আয়।’
একটু নীরবেই সূচনা হয়েছে পৌষের। তবে এরই মাঝে মাসটি তার প্রভাব স্পষ্ট করেছে। শীত পুরোদমে টের পাওয়া যাচ্ছে এখন। হ্যাঁ, শীত নামানোই পৌষের কাজ। কাজ বেশ জোরেসোরেই এগিয়ে চলেছে, বলা যায়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বললে: ‘শীত এসেছে লাগলো কাঁপন, লাগলো দোলা প্রাণে/শীত এসেছে হিমেল হাওয়া, আনন্দ আর গানে।’ শীতে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তিনি লিখেছেন, পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আয় আয় আয়…।
আবহাওয়াবিদদের মতে, বাংলাদেশ বিষুবরেখার উত্তরে। প্রায় সাড়ে ২৩ ডিগ্রি অক্ষাংশে। কিন্তু শীতকালে অবস্থান পরিবর্তন করে সূর্য বিষুবরেখার দক্ষিণে চলে যায়। দক্ষিণে কিছুটা হেলে থাকে। দিন ছোট হয়। বড় হতে থাকে রাত। এর ফলে শীতের প্রকোপ বাড়ে। বাংলাদেশে যখন শীতকাল, পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের দেশে দেশে তখন গ্রীষ্ম। ওসব দেশে বাতাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। উত্তর গোলার্ধ থেকে ঠান্ডা বাতাস দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা। সেখান থেকে বরফশীতল বায়ু এ দেশের ওপর দিয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে যে ঠান্ডা বাতাসের প্রবল প্রবাহ সৃষ্টি হয় তা শৈত্যপ্রবাহ নামে পরিচিত।
এ সময় তীব্র ঠান্ডা অনুভূত হয়। তবে মাঘের শীত সবচেয়ে বেশি আলোচিত। বলা হয়ে থাকে, মাঘের ভয়ে বাঘও পালায়। এদিকে, পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের শীতের সঙ্গে বাংলাদেশের শীতের পার্থক্য বিস্তর। কোনো কোনো দেশে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রিতে নেমে আসে। খুব কাছের দেশ চীনেও তাপমাত্রা মাইনাস নয়/দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে আসে। মেরু অঞ্চল বা এন্টার্কটিকার কথা তো বলাই বাহুল্য। অথচ বাংলাদেশে তাপমাত্রা ছয় থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে খুব একটা নামে না। সেদিক থেকে বাংলাদেশে শীত অনেক বেশি উপভোগ্য। সবার প্রিয় হলেও শীত সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে গ্রামীণ জীবনকে। গ্রামের সাধারণ কৃষক ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আইল্ল্যায় হাত সেঁকে কাজে বের হয়ে যান। তবে মূল ফসল ধান ঘরে চলে আসায় এ সময় তাদের হাতে সময়ও থাকে অনেক। নানা উৎসব আনন্দে মাতেন তারা। নতুন ধান থেকে পাওয়া চালে ঘরে-ঘরে চলে পিঠাপুলির আয়োজন। এখন টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন ফুটপাতেও বিক্রি হচ্ছে গরম গরম ভাঁপা পিঠা। চিতই পিঠা। পৌষে শহরে ঘন পিঠা উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। এবারও প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে।
পৌষের প্রকৃতিও অদ্ভুত সুন্দর। এ সৌন্দর্যের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘শীতের হাওয়ার লাগলো নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে।/ পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।’ আর প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা থেকে বললে, এ সময় সরিষার খেতে চোখ আটকে যায়। চোখ ধাঁধানো রূপ, রঙের খেলা মনে করিয়ে দেয় শীত এসেছে। খেজুরের রসে ভরে ওঠে মাটির কলসি। ম ম গন্ধ ছড়ায়। শীতকালে ফুলেরাও যেন বাড়তি আবেদন নিয়ে হাজির হয়। সৌন্দর্যের সবটুকু মেলে ধরে। মৌসুমি ফুলে ভরে ওঠে বাগান। হলুদ গাঁদা ফুল এরই মাঝে শীতকে স্বাগত জানিয়েছে। আর গোলাপ তো ফুল নয় শুধু, বিশেষ জাত। খুব প্রিয় গোলাপ সারা বছরই ফোটে। তবে এই এখন মৌসুম। গোলাপের মিষ্টি ঘ্রাণে ক্রমশ চারপাশ ভরে উঠছে। ফুটছে গ্ল্যাডিওলাস, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা, মোরগফুল। মুখ তুলে তাকাচ্ছে সূর্যমুখী। আকাশের দিকে তাকিয়েও এখন বোঝা যায়, শীত এসেছে। সেখানে উড়ে বেড়াচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে শীতের পাখিরা। প্রায় সারা দেশের বনে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের শাখায় এখন উৎসব চলছে পাখিদের। দেশীয় পাখিদের সঙ্গে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে যোগ দিয়েছে পরিযায়ী পাখিরা। কবির ভাষায়: শীতের পাখিরা বৈকাল থেকে উড়ে আসে নাতিশীতোষ্ণ দেশে।
এদিকে, সকাল হলেও এখন নিশ্চিত সূর্যালোকের দেখা মেলে না। ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ। রাতে শিশির ঝরছে। প্রকৃতির এ রূপ বর্ণনা করেই জীবনানন্দ লিখেছিলেন: শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;/নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি/উড়ে গেলো কুয়াশায়, -কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো…। অন্য কবির কবিতায় বর্ণনাটি এরকম: বিষাদের প্রতিমূর্তি হে শীত, সবুজের পোষাক খসিয়েছ/ নিয়েছ জড়িয়ে কুয়াশার শুভ্র চাদরে তপসীর সাধনায়…। পৌষে এই কুয়াশা এত হয় যে প্রতিদিনের সূর্য ওঠা ভোরও দেখা যায় না। সূর্যের আলোর জন্য প্রতীক্ষা করতে হয়। সুকান্ত তাই লিখেছিলেন: সকালের এক-টুকরো রোদ্দুর-/এক-টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামী।/ঘর ছেড়ে আমরা এদিক-ওদিকে যাই-/এক-টুকরো রোদ্দুরে তৃষ্ণায়…।
পৌষে শুরু হওয়া তৃষ্ণা আরও বাড়বে মাঘ মাসে গিয়ে। কারণ মাঘের শীতে বাঘ পালায়। অর্থাৎ, শীতের তীব্রতা অনেক বেড়ে যায়। তার আগে প্রস্তুতি সেরে নিয়েছেন তো? নিজে প্রস্তুতি নিন। ভাবুন চারপাশের হতদরিদ্র মানুষের কথাও। তাদেরও পাশে দাঁড়ান। তবেই প্রকৃত উদ্যাপন হবে শীতের।