
সাদ্দাম ইমন ॥
ভোরে গ্রামীণ রাস্তার দুই পাশে সারি সারি খেজুর গাছে ঝুলে থাকা রসের হাঁড়িগুলো নামিয়ে আনেন গাছিরা। টাটকা রসের স্বাদ পেতে প্রচণ্ড শীত আর কুয়াশা উপেক্ষা করে ভোরবেলা খেজুর রস খাওয়ার জন্য টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিনই ভিড় করছে মানুষ। গ্রামীণ রাস্তার দুই পাশে সারি সারি এসব খেজুর গাছ রয়েছে। প্রতিদিন ভোর ৫টায় তার ৪৪টি গাছে ঝুলে থাকা রসের হাঁড়িগুলো নামিয়ে আনেন গাছিরা। এ সময় নিচে অপেক্ষা করেন টাটকা রসের স্বাদ নিতে আসা নানা বয়সী লোকজন। খেজুরের রস শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভিড় লেগেই থাকে।
শীতকাল এলেই মানুষের মধ্যে খেজুরের রস খাওয়ার চল বেড়ে যায়। অনেকে গাছ থেকে খেজুরের কলসি নামিয়ে সরাসরি কাঁচা রস খেয়ে থাকেন। আবার অনেকে এই রস চুলায় ফুটিয়ে সিরাপ, পায়েস বা ক্ষীর বানিয়ে খান। এছাড়া রসের তৈরি ঝোলা গুড়, পাটালি গুড়, নলেন গুড়, ভেলি গুড়, বালুয়া গুড়, মিছরি গুড়সহ নানা ধরণের পিঠার বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। এই খেজুর রসে নিপাহ্ ভাইরাস আতঙ্কও রয়েছে। খেজুর আরব দেশের প্রচলিত ফল হলেও ওইসব দেশে খেজুর, মূলত ফল উৎপাদন নির্ভর, যেখানে কিনা বাংলাদেশের খেজুর গাছ রস উৎপাদন নির্ভর। কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, দেশে সাধারণত কার্তিক থেকে মাঘ অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ হয়ে থাকে। মূলত খেজুর গাছের ডালপালা পরিষ্কার করে, ডগার দিকের কাণ্ড চেঁছে তাতে একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি চোঙ বসিয়ে দেয়া হয়। চোঙের শেষ প্রান্তে ঝুলিয়ে দেয়া হয় একটি মাটির হাড়ি বা কলসি। সেই চোঙ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রস এসে জমা হতে থাকে মাটির হাড়ি বা কলসিতে। এভাবে একটি গাছ থেকে দৈনিক গড়ে পাঁচ থেকে ছয় লিটার রস সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই খেজুরের রস খাওয়ার ক্ষেত্রে নিপাহ্ ভাইরাস আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
এই খেজুর গাছগুলো খেজুরের রস পিপাসুদের কেন্দ্রস্থল। খেজুরের রস খাওয়ার পাশাপাশি খেজুর গাছ এবং খেজুরের রস নিয়ে ছবিও তোলেন অনেকে। খাঁটি খেজুরের রস শহরে পাওয়া যায় না, এমন কি গ্রামেও সচরাচর দেখা যায় না। শোনা যায় না চিরচেনা সে সুমধুর স্বর-খেজুরের রস নিবেন? খেজুরের রস। কোথাও কোথাও খেজুরের গুড় পাওয়া গেলেও দাম তুলনামূলক বেশি। তাই খেজুর গাছ যেখানে বেশি, সেখান থেকেই লোকজনকে খেজুরের গুড় সংগ্রহ করতে বেশি দেখা যায়। শীতের শুরুতে খেজুর রস লিটার ৮০ টাকায় বিক্রি করলেও চাহিদার কারণে দাম বেড়ে এখন লিটার ১০০ টাকায় বিক্রি করছেন বলে জানান সাজ্জাত হোসেন।
খেজুর গাছের মালিক সাজ্জাত হোসেন বলেন, মানুষের খেজুর রস খাওয়ার চাহিদা পূরণ করতে গাইবান্ধার রহমত আলী ও জালাল মিয়া নামে দুই ভাইকে কাজে লাগিয়েছেন। তারা খেজুর গাছের কাছে খেজুর গাছের পাতা দিয়ে তৈরি ঘরে থাকে। আর সারাদিন খেজুর গাছের পরিচর্যা করেন। ভোর বেলা ও রাতে খেজুর রস নামায় এবং দুপুর বেলায় খেজুর গাছ চেঁছে দেয়। ৪৪টি খেজুর গাছ থেকেই পর্যায়ক্রমে খেজুরের রস নামানো হয়। তবে খেজুরের রস পাইকারি বিক্রির সুযোগ থাকে না, কারণ খুচরা বিক্রি করেই সব শেষ হয়ে যায়।
রহমত আলী ও জালাল মিয়া জানান, খেজুর গাছের রস আহরণে তাদের ১৭ বছরের অভিজ্ঞতা। কুয়াশা ঢাকা শীতের সকালে টাটকা এক গ্লাস খেজুরের রসের তুলনা হয় না। এই মধুবৃক্ষ থেকে পাওয়া রস কাঁচা ও জ্বাল দিয়ে খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি এ রস দিয়ে তৈরি গুড় ও পাটালিরও তুলনা নেই। খনিজ ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খেজুরের রসে প্রচুর এনার্জি বা শক্তি রয়েছে। সাজ্জাত হোসেনের খেজুরের গাছের সামনে রস খেতে আসা লোকজনের ভিড় দেখা গেলো। তাদেরই একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাহিদ হাসান। তিনি বলেন, শীতে খেজুর রস খাওয়ার মজাই আলাদা, ঠাণ্ডায় বের হতে কষ্ট হলেও রস খাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে চলে এলাম। শহরের আদি টাঙ্গাইল এলাকার বাসিন্দা মোজাম্মেল মিয়া বলেন, শহরে খেজুর রস বিক্রি করার লোক পাওয়া যায় না। মানুষের কাছে শুনে শুনে খেজুরের রস খেতে এসেছি। আগে ভোর বেলায় খেজুর নামাতে দেখতাম। হাঁড়িতে ভরে ভরে গ্রামগঞ্জে শহরের আনাচে কানাচে খেজুরের রস বিক্রি করতে দেখতাম। আর এখন খেজুর গাছের অভাব, খেজুর গাছের পরিচর্যার অভাবে রস এখন আর তেমন পাওয়া যায় না। তবে বাঙালিদের খেজুরের রস খাওয়ার চাহিদা যেমন ছিল এখনও তেমনই আছে- এটা কেন্দুয়ার এই খেজুর তলায় এলে প্রমাণ মেলে।
প্রকৃতি প্রেমী মাসুদুর রহমান পেশায় ব্যবসায়ী। কুয়াশা ভেজা ভোরে বাকিদের মতো তিনিও ভিড় করেছেন সাজ্জাত হোসেনের গাছের খেজুরের রস খেতে। ছোটবেলার স্মৃতি হাতড়ে বলেন, সেসময় ক্ষেতের আইলে চলতে চলতে শিশিরে ভিজে যেত পায়ের পাতা। সন্ধ্যে হলেই দেখতাম, গাছে বাঁধা হচ্ছে হাঁড়ি। সকাল হতে না হতেই খেজুর রসের চেনা স্বাদে মাতোয়ারা হতে উঠত চারপাশ। বাড়ির উঠোন বা ধান কেটে নেওয়া শূন্য মাঠে গোল হয়ে বসে শীতের মধ্যে রসে স্বাদ নিত সবাই। এখন ইট-পাথরের নগরে এসব পাওয়া কঠিন। কিন্তু অনেক দিন পর বন্ধু টিপু মুন্সির ডাকে সাড়া দিয়ে এই খেজুর তলায় এসে ভিড় থেকে এক লিটার খেজুর রস পেলাম। খুবই ভালো লাগলো। এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক মির্জা রানা খানসুর বলেন, শৈশব-কৈশোরটা যাদের গ্রামে কেটেছে, খেজুর গাছ থেকে রসের হাঁড়ি চুরি করে রস খাওয়া তাদের এটি মূল্যবান স্মৃতি। এ স্মৃতি ভোলার নয়। এ যুগের ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন ধরনের কোমল পানীয়ের স্বাদ জানে। কিন্তু তারা খেজুর রসের স্বাদ জানে না। এটার প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত। এটা আমাদের ঐতিহ্য। খেজুরে আলাপ বিরক্তিকর হলেও খেজুর রসেরও কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে।