হাবিবুর রহমান, মধুপুর ॥
বন্যপ্রাণী হত্যা করা, আহত করা দন্ডনীয় অপরাধ। সাবধানে গাড়ী চালান, বন্যপ্রাণীর অবাধ চলাচল নিশ্চিত করুন। নির্দেশক্রমে টাঙ্গাইল বনবিভাগ। জনসাধারণ, পথচারী, গাড়ী চালকসহ সকলের দৃষ্টি আর্কষণ করে এমন সচেতনতা বিষয়ক সাইনবোর্ড সাটানো রয়েছে টাঙ্গাইল বন বিভাগের জাতীয় উদ্যানের মুল ফটকের বাম পাশসহ বনের বিভিন্ন স্থানে। যা টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী জনসাধারণ ও গাড়ী চালকদের দিব্যি চোখে পড়ার মতে। এরপরও মাঝে মধ্যে গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে টাঙ্গাইলের মধুপুর বনের বানর, হনুমানসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীরা। আহতও হচ্ছে এসব প্রাণী। গাড়ির হর্ণ আর শব্দ দূষনে তটস্থ হচ্ছে প্রাণীরা। ব্যাহত হচ্ছে তাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য পরিবেশে নির্বিঘেœ চলাচল আর বসবাস। শব্দ দূষনের বিরুপ প্রভাবে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। বন্যপ্রাণীদের অবাধে চলাচল নিশ্চিত করণের জন্য বন্যপ্রাণী আইন মেনে চলা ও সচেতনতা বাড়ানোর দাবি সংশ্লিষ্টদের।
জানা যায়, দেশের তৃতীয় বৃহত্তর বনাঞ্চল মধুপুর শালবন। ইতিহাসখ্যাত এ শালবন নানা ঐতিহ্যের কারণে বিখ্যাত। শালবৃক্ষ নানা বৈচিত্র্যময় গুল্মলতা, ভেষজ উদ্ভিদ, বন্যপ্রাণী, পাখি, ভূ-বৈচিত্র্য, প্রকৃতি, পরিবেশ, মাটিসহ সমতল এলাকার এ বনের ঐতিহ্য পরিচিত দেশজুড়ে। দেশের বাইরেও রয়েছে এ বনের পরিচিত। আশির দশক থেকে বন সংকুচিত হওয়ায় বন্য পশুপাখিও কমে যাচ্ছে। কালোমুখ হনুমান ও বানর এখনো অনেক রয়েছে। এছাড়াও কাঠ বিড়ালী, গুইসাপ, বেজি, শিয়াল, বন মোরগসহ বিভিন্ন ছোট-বড় পশুপাখি চোখে পড়ে। তবে বানরের পরিমান অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে একটু বেশি। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কের রসুলপুর থেকে শুরু করে পঁচিশ মাইল পর্যন্ত বনের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলা রাস্তার পাশে বিভিন্ন স্থানে দলগতভাবে বানর চলাচল করে। দলগত ভাবে খাদ্যের সন্ধানে রাস্তা পারাপার হয়ে থাকে। এজন্য বন্যপ্রাণীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে জনসাধারণ, গাড়ী চালকসহ সকলের দৃষ্টি আর্কষণের জন্য বনের রাস্তাঘাটের দর্শনীয় স্থানে এমন সাইন বোর্ড টানিয়ে দিয়েছে বন বিভাগ। এমন সর্তকীকরণ সাইন বোর্ডও কাজে আসছে না। মানছে না ভ্যান-রিকসা, মোটরসাইকেল, সিএনজি, অটোবাইক, ট্রাক, বাসের চালকরা। আইন না মানায় গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে, আহত হচ্ছে বন্যপ্রানী।
মধুপুর বনের ভেতরে মুনার বাইদের একটু আগেই দেখা গেল রাস্তার উপর একটি বানর গাড়ীর নিচে পিষ্টে নিহত হয়ে পড়ে আছে। পথচারীরা জানালেন, একটু আগে গাড়ীর সাথে ধাক্কা লেগে বানরটি মারা গেছে। চারপাশে বানের দল এসে দাঁড়িয়ে আছে। বানরের দল চিকচিক খেক খেক শব্দে আহাজারি করছে। চারদিকে থেকে বানরের দল নিহত বানরটির নিকট আসার চেষ্টা করেও আসতে পারছে না। অবিরাম যান চলাচল করার কারণে। দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন জানালেন, মাঝে মধ্যেই বেপরোয়া গতির গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে এভাবেই প্রাণ হারায় বন্যপ্রাণীরা। এমন দিব্যি সাইন বোর্ডেও কমছে না বন্য পশুপাখির প্রাণহানী। সাধারণ মানুষ মনে করছে, যথাযথ আইন প্রয়োগ করে মধুপুর বনের বন্যপ্রাণী রক্ষা জরুরি। তা না হলে এভাবে মৃত্যুর মিছিল বাড়তে থাকলে কমতে থাকবে প্রাণীকুল। পরিবেশ হারাবে ভারসাম্য। বিপন্ন হবে প্রকৃতি। এসব তথ্য স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
পরিবেশ রক্ষা সোসাইটির টাঙ্গাইল জেলা শাখার সভাপতি লিয়াকত হোসেন জনি বলেন, বন্যপ্রানীরা খাদ্যের সন্ধানে রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে অনেক সময় বেপরোয়া গতির গাড়ির চাপায় প্রাণ হারায়। বন্যপ্রাণীদের প্রতি চালকদের সদয় হওয়া প্রয়োজন। যথাযথ আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতার মধ্যে দিয়ে এটা রোধ করতে হবে বলে তিনি মনে করেন। জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক জানান, বন এলাকার পঁচিশ মাইল থেকে রসুলপুর পর্যন্ত রাস্তায় প্রায় সময় দেখা যায় শিয়াল, গুইসাপ সাপ, হনুমান, বানর গাড়ির সাথে দুর্ঘটনায় মারা যায়। বিদেশে রাস্তার পাশে বন্যপ্রাণীদের জন্য নেটের বেড়া দিয়ে থাকে। বেড়া দিয়ে, আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতার মধ্যে দিয়ে বন্যপ্রাণী দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলার) বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র চন্দ বলেন, জীববৈচিত্র্য এবং বন্যপ্রাণী আইনে বন্যপ্রাণী রক্ষার ক্ষেত্রে আইন মানা সকল নাগরিকের দায়িত্ব। বন্য প্রাণী আহত বা নিহত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইনগতভাবে ব্যবস্থা নিবে। যানবাহন বনের ভিতর চলাচলের ক্ষেত্রে আইন মেনে চলতে হবে। আইনের অমান্য করলে বিধি মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধে দন্ডিত হবে বলে তিনি মনে করেন ।
এ বিষয়ে মধুপুর জাতীয় উদ্যান সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, সে দিন বানর নিহত হওয়ার খবর পেয়ে গিয়েছিলেন। বনের ভেতরে সড়কে অনেক সময় বানরের দল চলাচল করে, খেলা করে। দ্রুত গতিতে গাড়ি চলাচলের কারণে বন্যপ্রাণীরা নিরাপদ দুরত্বে থাকতে পারে না। ফলে প্রাণ হারায়। বনের ভেতরে চলাচলের সময় গাড়ির গতিসীমা কমিয়ে গাড়ি চলাচল করা উচিত। আইন মেনে চললে বন্যপ্রাণীরা নির্বিঘেœ নিরাপদে চলাচল করতে পারবে।