
হাসান সিকদার ॥
আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও পাঁচবারের সাবেক সংসদ সদস্য বিদেশে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে মন্ত্রীত্ব হারানো প্রাজ্ঞ রাজনীতিক ব্যক্তি আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বদনাম ঘোচাতে এবার টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হতে দুইটি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়নের হাট-ঘাট, গ্রাম-মহল্লা চষে বেড়াচ্ছেন। মন জয় করতে ফজরের নামাজ পড়ে ছুটে যাচ্ছেন ভোটারদের বাড়ি বাড়ি। এবার নির্বাচনে লতিফ সিদ্দিকী ইমেজ পুনরুদ্ধারে ভোটের মাঠে নেমেছেন। এবার নির্বাচনের মাঠে প্রতিপক্ষ হয়েছেন নৌকা প্রতিকের প্রার্থী ও তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার।
আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সাবেক সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রীত্ব কেড়ে নেওয়া ও দল থেকে বহিষ্কার করার পর তিনি জাতীয় সংসদ থেকেও পদত্যাগ করেন। এরপর প্রায় দীর্ঘ পাঁচ বছর রাজনীতির মাঠ ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারও সঙ্গে তেমন দেখা-সাক্ষাত ও কথা-বার্তা বলেন নি। নিজ এলাকায় এলেও পারিবারিক পরিমন্ডলের বাইরে মেলামেশা করেন নি। যাদের সাথে তিনি দীর্ঘ জীবন রাজনীতির ময়দানে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন তারাও তার তর্কিত কান্ডে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। নির্বাচনী এলাকায় বিরোধী পক্ষের লোকজন তার তর্কিত কর্মকান্ড জনগনের কাছে ফলাও করে প্রচার করে ফায়দা লুটে নিতে সক্ষম হয়। চার দিক থেকে এক প্রকার কোণঠাসা হয়ে পড়েন তিনি।
এদিকে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোজহারুল ইসলাম তালুকদার। নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে তার কর্মী-সমর্থকরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্নস্থানে গণসংযোগ, সভা, মতবিনিময় ও উঠান বৈঠক করছেন। নৌকার প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার বলেন, কালিহাতীতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকাকে বিজয় করতে হবে। এমন কাউকে বিজয়ী করবেন না যাকে সুখে-দুখে পাশে পাওয়া যায় না। নির্বাচনকে বানচাল করার জন্যে বিএনপি সন্ত্রাস ও নাশকতা সৃষ্টির জন্য পাঁয়তারা করছে। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক সকলকে সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগই পারবে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও রাষ্ট্রক্ষমতায় আনতে। সকল ভেদাভেদ ভুলে সকলকে নৌকার পক্ষে কাজ করতে হবে। কালিহাতীতে নৌকার কোন বিকল্প নেই। নৌকার পক্ষে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। মোজহারুল ইসলাম তালুকদার কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের টানা ৩২ ধরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে গিয়ে অনেক জেল-জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার সহ্য করেছেন।
রাজনৈতিক অঙ্গনে বেখবরে থাকা এক সময়ের দুর্দান্ত প্রতাপশালী রাজনীতিক লতিফ সিদ্দিকী এবার জনসম্মুখে এসেছেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন এই হেভিওয়েট প্রার্থী। তার হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধারে এবং জনগনের সুখ-দুঃখের অংশিদার হতে নির্বাচনের মাঠ-ঘাট চষে বেড়াচ্ছেন। নির্বাচত হওয়ার প্রত্যয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের কমান্ডার ইন চীফ আবদুল লতিফ সিদ্দিকী টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সাতবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। তিনি পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিগত ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে একটি অনুষ্ঠানে হজ ও তাবলীগ জামাত সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করে ইসলামপন্থীদের বিরাগভাজন হন। দলের সুবিধাবাদীরা সুযোগ নেয়। এজন্য তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার ও মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করা হয়। সংসদ থেকেও তিনি পদত্যাগ করেন। গত সেপ্টেম্বরে তিনি কালিহাতীতে আনুষ্ঠানিকভাবে গণসংযোগ শুর করেন। তাঁর কর্মসূচিতে কাদের সিদ্দিকীসহ পরিবারের সবাই-সহায়তা করেন।
সাবেক পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী প্রাজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, ১৯৭৩, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে মন্ত্রিত্ব পান। সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন। মন্ত্রী সভার টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। বিগত ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে একটি সভায় হজ ও তাবলীগ জামাত সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করে মন্ত্রীত্ব হারান লতিফ সিদ্দিকী। তখন তাঁকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। দেশে ফেরার পর তাঁকে কারাগারেও যেতে হয়। পরে তিনি সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তাঁর গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এর প্রতিবাদে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে তিনি অবস্থান ধর্মঘট করেন। পরে নির্বাচন থেকে সরে যান। এ ঘটনার পর থেকে কালিহাতীর রাজনীতিতে তিনি নিস্ক্রিয় ছিলেন। প্রায় পাঁচ বছর পর তিনি কালিহাতী আসনে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে গণসংযোগ করছেন।
বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগকালে তিনি কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত দুই মাস ধরে তিনি কালিহাতীর মানুষের ভালোবাসার আওয়াজটা জানার চেষ্টা করেছেন। মানুষের ভালোবাসা পুঁজি করে তিনি নির্বাচনে এসেছেন। তিনি এবার (ট্রাকগাড়ি) প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে মানুষের ভালোবাসাই তাকে বিজয়ী করবে বলে বিশ্বাস করেন। নির্বাচনে তিনি কোনদিন দাঙ্গা-হাঙ্গামা বরদাস্ত করেন নি- এখনও করবেন না। কোন প্রকার জালভোট, পেশিশক্তির ব্যবহার করে কেন্দ্র দখলের মাধ্যমে ভোট আদায়, অর্থ দিয়ে ভোটার প্রলুব্ধ করে ভোট আদায় ইত্যাদি অপকৌশলকে তিনি ঘৃণা করেন। ইতোমধ্যে তিনি উপজেলার প্রতিটি গ্রামে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে কেন্দ্র কমিটিও করার কথা বলেছেন। কর্মীদের প্রত্যেককে একেকজন ‘লতিফ সিদ্দিকী’ হয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাইতে নির্দেশ দেন। এসব বিষয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী লতিফ সিদ্দিকী বলেন, এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিত করা। ভোটারদের কেন্দ্রে নির্বিঘেœ যাতায়াত ও নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করা। কোনো প্রকার জাল-জালিয়াতি নয়। অর্থের প্রলোভন নয়। পেশিশক্তির বাহাদুরি নয়। ভোটাররা নির্বিঘœ ও স্বাধীনভাবে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে- এটাই প্রত্যাশা করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, গত দুই মাস ধরে আমি কালিহাতীর মানুষের ভালোবাসার আওয়াজটা জানার চেষ্টা করেছি। মানুষের ভালোবাসা পুঁজি করে আমি নির্বাচনে এসেছি। (ট্রাকগাড়ি) প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি। নির্বাচনে মানুষের ভালোবাসাই আমাকে বিজয়ী করবে।
টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনে তিনি ছাড়াও অন্য প্রার্থীরা হচ্ছেন- উপজেলা আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সভাপতি (নৌকা) প্রতীকের প্রার্থী মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু, মহান স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক ও সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত শাজাহান সিরাজের মেয়ে (ঈগল) প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সারওয়াত সিরাজ শুক্লা, কালিহাতী উপজেলা জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য (লাঙ্গল) প্রতীকের প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার লিয়াকত আলী, জাতীয় পার্টির (জেপি-মঞ্জু) কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব (বাইসাইকেল) প্রতীকের প্রার্থী সাদেক সিদ্দিকী, জাকের পার্টির (গোলাপ ফুল) প্রতীকের প্রার্থী মোন্তাজ আলী, তৃণমূল বিএনপির (সোনীল আঁশ) প্রতীকের প্রার্থী শহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (একতারা) প্রতীকের প্রার্থী শুকুর মামুদ।
এই আসনে মোট ভোটার তিন লাখ ৫৪ হাজার ৫৫৬ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৭৮ হাজার ৮৯২জন, নারী ভোটার এক লাখ ৭৫ হাজার ৬৬২জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার দুই জন।