সদর আসনে নৌকা ঈগলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই

টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল সদর টাঙ্গাইল স্পেশাল রাজনীতি লিড নিউজ

হাসান সিকদার ॥
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচারনায় সরগরম হয়ে উঠেছে নির্বাচনের মাঠ। প্রার্থীরা ভোটারদের বাড়ি-বাড়ি গিয়েও ভোট চাচ্ছেন অবিরত। টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে নৌকা আর ঈগল প্রতীকের প্রার্থীরা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত বিরামহীনভাবে নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী নিজে এবং তাদের কর্মী-সমর্থকরা দিনরাত গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। পোস্টার, মাইকিং, পাড়া-মহল্লায় গণসংযোগ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। এ আসনটিতে প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে একাদশ সংসদ পর্যন্ত কাকতালীয়ভাবে সদর আসনের বিজয়ী প্রার্থীর দলই সরকার গঠন করেছে।
এদিকে মনোনয়ন লাভের আশায় গত এক বছর ধরে নির্বাচনী এলাকায় তৎপর ছিলেন আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এডভোকেট মামুন অর রশিদ। শেষ পর্যন্ত তিনি বর্তমান এমপিকে টপকিয়ে মনোনয়ন পেয়ে যান। জেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা এবং কিছু জনপ্রতিনিধিরা বর্তমান এমপি ছানোয়ারের পক্ষে কাজ করার ফলে নির্বাচনী লড়াইয়ে ‘ঈগল’ নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে নৌকার অনুসারীদের মধ্যে। এদিকে প্রচারনার শুরুর দিকে নৌকা ও ঈগলের সমর্থকের মধ্যে গুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব কারণে জেলার অন্যান্য আসনের তুলনায় টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে নির্বাচনী উত্তাপ সবচেয়ে বেশী। এবার এই আসনে মোট ৯ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নৌকা ও ঈগলের মধ্যে। আওয়ামী লীগ মনোনীত (নৌকা) প্রতীকের প্রার্থী কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এডভোকেট মামুন অর রশিদের সাথে বর্তমান এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি স্বতন্ত্র (ঈগল) প্রতীকের প্রার্থী ছানোয়ার হোসেনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। নির্বাচনে কে হচ্ছেন এই আসনের সংসদ সদস্য তা নিয়ে সর্বত্র চলছে নানা আলোচনা। বর্তমান এমপি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় সকল হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে। কে বিজয়ী হবেন তা কেউ সঠিক বলতে পারছেন না। তবে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি এমনটাই মনে করছেন ভোটাররা। নৌকা-ঈগলের লড়াই জমে উঠেছে। আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে বর্তমান এমপি ছানোয়ার সর্মথিত নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সব মিলিয়ে এ আসনে চলছে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা। কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন প্রার্থীরা।
জানা যায়, বিগত ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নৌকা নিয়ে নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী ছানোয়ার হোসেন। সদর উপজেলায় তিনি উন্নয়নমূলক বহু কাজ করেছেন। তারপরও এবার তিনি মনোনয়ন পাননি। তার পক্ষে কাজ করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান আনছারী, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুজ্জামান সোহেল, মহিলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ও কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানবৃন্দরা।
এদিকে বিগত ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন এডভোকেট মামুন অর রশিদ। জোটের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই নির্বাচনে তাকে বসিয়ে দেন। তার পক্ষে কাজ করছে জেলা, উপজেলা, পৌর ও বিভিন্ন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ও কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানবৃন্দরা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল তীব্র ও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। দশম ও একাদশ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এমপি ছানোয়ার হোসেন ক্যাডার বাহামমুক্ত থেকে কাজ করেছেন। তিনি দ্বাদশ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন পাননি তিনি। এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র (ঈগল) প্রতিকের প্রার্থী ছানোয়ার হোসেন এমপি বলেন, আমার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষরা বিভিন্ন অপবাদ ছড়ান। দীর্ঘদিন পর এই সদর আসন আওয়ামী লীগের হাতে এসেছে। অতীতে এখান থেকে যারাই এমপি, মন্ত্রী হয়েছেন তাদের সাথে ঢাকা গিয়ে কর্মিদের দেখা সাক্ষাত করতে হয়েছে। বর্তমান এমপি কর্মি ও জনগণের দোড়গোড়ায় গিয়ে কড়া নাড়ে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুত অনুযায়ী উন্নয়মুলক কর্মকান্ড করে যাচ্ছি। শতভাগ সফল হয়েছি বলবো না। তবে এই নির্বাচনে আমি (ঈগল) প্রতিক নিয়ে জয়লাভ করে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে এই সদর আসনটি আবারো উপহার দিতে পারবো।
এছাড়া টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এ্যাডভোকেট মামুনুর রশিদ মামুন মনোনয়নের প্রত্যাশায় এক-দেড় বছর ধরে গণসংযোগ করছেন। তিনি টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে পরিচিত ও পুরনো মুখ। টাঙ্গাইলে ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে বর্তমান কেন্দ্রীয় যুবলীগের নেতৃত্বদানের মধ্য দিয়ে দল ও কর্মীদের কাছে পরীক্ষিত নেতা। তিনি মাঝে বেশকয়েক বছর রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে দেশ ছাড়েন। পরে দেশে এসে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মনোনীত হন। দীর্ঘদিন টাঙ্গাইলের রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও গত এক-দেড় বছর ধরে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও দলীয় সকল কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। এখন দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এ্যাডভোকেট মামুনুর রশিদ মামুন বলেন, সাধারণ মানুষ পরিবর্তন ও উপযুক্ত প্রতিনিধি চাচ্ছে। দীর্ঘ ১৫ বছর আগে জননেত্রী শেখ হাসিনা টাঙ্গাইলে এসে একটি চারাগাছ বুনে গিয়েছিলেন, সেই চারাগাছ আমি। আমার সাথে জনগন আছে। যেখানেই যাই সেখানেই মানুষ আমার কাছে আসে। জনগনের ভালবাসায় ও নেত্রীর নিদের্শে সদর উপজেলায় নিবেদিত, পরীক্ষিত মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
এদিকে বহুদিন থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন টাঙ্গাইলের এক সময়ের প্রতাপশালী সিদ্দিকী পরিবারের অন্যতম সদস্য মুরাদ সিদ্দিকী। তিনি এ আসনে একজন স্বতন্ত্র (মাথাল) প্রতিকের প্রার্থী। এর আগেও তিনি এ আসন থেকে ৫ বার জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছেন। প্রতিবারই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোট পেয়েছেন। মুরাদ সিদ্দিকীর সমর্থকদের ধারণা তার প্রাপ্ত ভোটগুলো আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাপার বাইরের। এবারের নির্বাচন বিষয়ে স্বতন্ত্র (মাথাল) প্রতিকের প্রার্থী মুরাদ সিদ্দিকী বলেন, জনগন আমাদের সাথে আছে। আমি নির্বাচিত হলে টাঙ্গাইলে একটি ইপিজেড নির্মাণ করবো। যেখানে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। টাঙ্গাইল থেকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ এবং নেশা উৎখাত করবো। কারণ নেশাটা যুবসমাজকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যায়। নির্বাচিত হতে পারলে স্বাস্থ্য সেবাসহ সাধারণ মানুষের চাওয়া ও জীবনমান উন্নয়ন করবো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনেই বেশি নির্বাচনী আমেজ আছে। এখানে এলে বোঝা যায়, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হচ্ছে। দুই প্রার্থীর সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। আওয়ামী লীগের উপজেলা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কিছু নেতাকর্মী প্রকাশ্যে ও গোপনে ছানোয়ার হোসেনকে বিজয়ী করার জন্য সক্রিয়ভাবে সমর্থন দিচ্ছেন বলে জানান তারা। বিভিন্ন ইউনিয়নের নতুন ভোটাররা জানান, যিনি এলাকার উন্নয়ন, যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং গরিব-দুঃখীর পাশে দাঁড়াবেন তাকেই ভোট দিয়ে বিজয়ী করবেন। বিভিন্ন এলাকার ভোটাররা বলেন, খুব বিপদে পড়েছি। একজন নৌকা নিয়ে এসেছেন, আরেকজন বর্তমান এমপি। কে ভোটে উঠবে, তা বলা যাচ্ছে না। তবে নৌকা এবং ঈগলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
এ আসনে আরও ভোটের মাঠে লড়ছেন বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর ছোট ভাই মুরাদ সিদ্দিকী (স্বতন্ত্র-মাথাল), মোজাম্মেল হক (জাতীয় পার্টি-লাঙ্গল), এডভোকেট খন্দকার আহসান হাবিব (স্বতন্ত্র-কেটলি), হাসরত খান ভাসানী (বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি-একতারা), শরিফুজ্জামান খান (তৃণমূল বিএনপি-সোনালী আঁশ), তৌহিদুর রহমান চাকলাদার (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-নোঙ্গর), জামিলুর রহমান মিরন (স্বতন্ত্র-ট্রাক) নৌকার প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে তিনি নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়িয়েছেন।
টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসন একটি পৌরসভা ও ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এখানে মোট ভোটার ৪ লাখ ৩৪ হাজার ১৯৪ জন। পুরুষ ভোটার ২ লাখ ১৭ হাজার ৪৭২, নারী ভোটার ২ লাখ ১৬ হাজার ৭২২ জন।

 

২৩৮ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *