
হাসান সিকদার ॥
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি না থাকায় টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ি) আসনে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, কৃষিমন্ত্রী ও পঞ্চমবারের মতো নৌকা প্রতিকের প্রার্থী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনে তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আহসানুল ইসলাম টিটু রয়েছেন অনেকটা ফুরফুরে অবস্থায়। অপর ছয়টি আসনে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে জয় নিয়ে শংকায় রয়েছে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অনেকেই বিজয়ী হবেন এমনটাই প্রত্যাশা করছেন ঈগল ও ট্রাক প্রতিকের প্রার্থী ও সমর্থকরা।
মধুপুর-ধনবাড়ি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির বহিস্কৃত নেতা আনোয়ারুল হক। তিনি ১৯৮৮ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচিত হন। পরে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন। এরশাদ সরকারের পতনের পর তিনি বিএনপিতে যোগাদান করেন। মধুপুর উপজেলা বিএনপির তিনি সদস্য ছিলেন। এবার তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় দল তাকে বহিস্কার করেছে। ফলে বিএনপির কোন নেতাকর্মি তার সাথে নেই। মাইকিং, প্রচারণা ছাড়া তার তেমন কোন নির্বাচনী কার্যক্রম নেই। অপর তিন প্রার্থী মোহাম্মদ আলী (জাতীয় পার্টি), ফারুক আহাম্মেদ (কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ), ইসলাম (জাকের পার্টি) কার্যক্রম মাইকিং প্রচারনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
এদিকে মধুপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিউদ্দিন মনি ও সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান ছরোয়ার আলম খান আবু ও তার ভাই গোলাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বাবলুর সাথে উপজেলা আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব রয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর ড. আব্দুর রাজ্জাকের নির্বাচনী ক্যাম্প ভাংচুর করার অভিযোগ উঠে তাদের বিরুদ্ধে। ধনবাড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও পৌরসভার সাবেক মেয়র মঞ্জুরুল ইসলাম তপন বলেন, মধুপুরে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকলেও ড. রাজ্জাকের বিজয়ের ব্যাপারে দুই উপজেলার আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ রয়েছে।
এদিকে টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনে বর্তমান এমপি আহসানুল ইসলাম টিটু তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তার সাথে নাগরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাকিরুল ইসলাম ইউলিয়াম ও সাধারণ সম্পাদক কুদরত আলী ও দেলদুয়ার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লায়ন এম শিবলী সাদিকের দীর্ঘ দিনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। উইলিয়াম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছিলেন। মনোনয়নপত্র দাখিলের সাথে ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরে গড়মিল ও ঋণখেলাপী থাকায় তার প্রার্থীতা বাতিল করেন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা। কিন্তু হাইকোর্ট করেও প্রার্থীতা ফিরে পাননি। পরে দ্বন্দ্ব কোন্দল ভুলে টিটুর সাথে এক মঞ্চে উঠেছেন সবাই। তারা টিটুর জন্য ভোট প্রার্থনা করছেন। এ আসনে টিটুর সাথে শক্ত কোন প্রতিদ্বন্দ্বি নেই। স্বতন্ত্র তিন প্রার্থী ব্যারিষ্টার আশরাফ হোসেন, সৈয়দ মাহমুদুল ইলাহ, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি তারেক শামস খান হিমু ও জাতীয় পার্টির আবুল কাশেমের তোমন কোন প্রচার প্রচারণা নেই। প্রচারণায় শুধু মাইকের উপর ভরসা করছেন তারা। তাদের নেই কোন নির্বাচনী অফিস। কোন প্রকার প্রতিদ্বন্দ্বি ছাড়াই বিজয়ী হবেন টিটু এমনটাই আশা করছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মিরা। বিগত ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টি জোটভুক্ত হলে আবুল কাশেম জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবার তাকে টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। দেলদুয়ারে তার জন্ম হলেও দুটি উপজেলায় তার তেমন পরিচিতি নেই। স্বতন্ত্র প্রার্থী তারেক শামস খান হিমু বিগত ২০০৯ সালে নাগরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সামান্য ভোট পেয়েছিলেন। তার সুসংহত কোন অবস্থান নেই। উপজেলা আওয়ামী লীগের কোন নেতাকর্মির তার সাথে নেই। এ আসনে অপর প্রার্থীরা হলেন, মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন (বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন), আব্দুল করিম (বিএসপি), বিএনপির বহিস্কৃত খন্দকার ওয়াহিদ মুরাদ (বিএনএম)। নাগরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহিদুল ইসলাম অপু বলেন, যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তাদের কোন ভিত্তি নেই। তাদের সাথে তৃণমূল নেতাকর্মিদের কোন সম্পর্ক নেই। এলাকায় তাদের কোন পরিচিতিও নেই। আহসানুল ইসলাম টিটু এবারও বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন।
এছাড়া ছয়টি আসনে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের। আসনগুলো হলো- টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনে নৌকার প্রার্থী ছোট মনিরের সাথে স্বতন্ত্র (ট্রাক) প্রতিকের প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনুছ ইসলাম তালুকদারের সাথে ভোট যুদ্ধ হবে। টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ও টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান। এখানে স্বতন্ত্র (ঈগল) প্রতিকের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করছেন সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খানা রানা। টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন কালিহাতী উপজেলা সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু। এখানে স্বতন্ত্র (ট্রাক) প্রতিকের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, পাঁচবারের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী।
টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অ্যাডভোকেট মামুন অর রশিদ। এখানে স্বতন্ত্র (ঈগল) প্রতিকের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করছেন দুইবারের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছানোয়ার হোসেন। বর্তমান এমপি ছানোয়ারের পক্ষে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শাজাহান আনসারী, সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুজ্জামান খান সোহেল প্রকাশ্যে এবং পৌরসভার মেয়র ও টাঙ্গাইল শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল হক আলমগীরের কর্মীসমর্থকরা নির্বাচনে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনে একাব্বর হোসেন সাতবারের এমপি ছিলেন। তার মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খান আহমেদ শুভ। এবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে মনোনয়ন না পেয়ে তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র (ট্রাক) প্রতিকের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মির্জাপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মীর এনায়েত হোসেন মন্টু। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মীর শরীফ মাহমুদ, প্রয়াত সংসদ সদস্য একাব্বর হোসেনের ছেলে সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার তাহরীম হোসেন সীমান্ত, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রাফিউর রহমান ইফসুফজাই সানি, মেজর (অব) খন্দকার আব্দুল হাফিজ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল কালাম আজাদ লিটন সমর্থন দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির প্রায় দুই তৃতীয়াংশ নেতা সমর্থন দিয়ে প্রচারণা চালিয়ে নির্বাচনী মাঠ সরব করে তুলেছেন।
টাঙ্গাইল-৮ (সখীপুর-বাসাইল) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন সখীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি অনুপম শাহজাহান জয়। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকলেও অনুপম শাহজাহান জয়কে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীকে নির্বাচনে মোকাবেলা করতে হবে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান এমপি এডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহেরের নেতৃত্বে বিশাল একটি অংশ নৌকার প্রার্থী জয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা নির্বাচন থেকে দূরে রয়েছেন। এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর জনপ্রিয়তার কাছে নৌকা জয়ী হলে চমক হিসেবেই দেখা হবে।