জাহিদ হাসান ॥
আওয়ামী লীগে একটি প্রবাদ রয়েছে যে বিজয়ী হওয়ার চেয়ে মনোনয়ন পাওয়া অনেক কঠিন। মনোনয়ন পেয়েও কিন্তু এবার সংসদ সদস্য পদে বিজয়ী হওয়া নিয়ে আশংকায় রয়েছেন কয়েকজন নৌকার মনোনীত প্রার্থী। টাঙ্গাইলের আটটি সংসদীয় আসনের মধ্যে পাঁচটি আসনেই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা। মূলত এসব আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে ও অন্তরালে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর), টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী), টাঙ্গাইল-৫ (সদর), টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার), টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) ও টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের কতিথ প্রভাবশালী বহু নেতাকর্মীরা নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করছেন। এ কারণে এই ৬টি আসনে নৌকার প্রার্থীরা বেকায়দায় পড়েছেন। টানা ১৮ দিন নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শেষে এমন তথ্যই জানা গেছে।
এদিকে টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে আওয়ামী লীগের মধ্যে কোন্দল না থাকায় এবং সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নৌকার প্রার্থীর পক্ষে একযোগে করছে। এছাড়া টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনে আহসানুল ইসলাম টিটুর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি না থাকায় এবং কিছু কিছু নেতা গোপনে স্বতন্ত্র (ঈগল) প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনে স্বতন্ত্র (ঈগল) প্রতিকের প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনুছ ইসলাম তালুকদার। তার সাথে রয়েছে ভুঞাপুর পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়য়ামী লীগের সভাপতি মাসুদুল হক মাসুদ, গোবিন্দাসী ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান আমিন, চেয়ারম্যান মাসুদ মিয়া। এছাড়াও গোপালপুর পৌরসভার মেয়র রকিবুল হক ছানা, ঝাওয়াইল ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান তালুকদার, ভারপ্রাপ্ত উপজেলা চেয়ারম্যান মীর রেজাউল হক সাবেক এমপি আসাদুজ্জামানের ছেলে মশিউজ্জমান রোমেলসহ অসংখ্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মিরা। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনীত (নৌকা) প্রতিকের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির। ইতিমধ্যে কয়েকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছেন দুইপ্রার্থীর সমর্থকরা। দুই প্রার্থীকেই তলব করেছিলেন নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটি। তাদের সতর্ক করা হয়েছে। মূলত এই দুই উপজেলায় আওয়ামী লীগের কতিথ প্রভাবশালী নেতারা নৌকার পক্ষে কাজ না করায় এখানে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে দুই প্রার্থীও মধ্যে। অপর প্রার্থীদের কার্যক্রম শুধু মাইকিংয়ে সীমাবদ্ধ ছিলেন।
টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ও টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান। সজ্জন ব্যাক্তি হিসেবে পরিচিত কামরুল হাসান দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় কাজ করে যাচ্ছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার পক্ষে কাজ করছেন। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন বর্তমান সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খান। তিনি মনোনয়ন পাননি। তবে স্বতন্ত্র (ঈগল) প্রতিকের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করছেন তার ছেলে সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খানা রানা। বিগত ২০১৩ সালের (১৮ জানুয়ারি) টাঙ্গাইল শহরের কলেজপাড়া এলাকায় নিজ বাড়ির কাছে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যাকান্ডের শিকার হন। ওই মামলায় প্রায় তিন বছর হাজতবাস খেটে বর্তমানে জামিনে মুক্ত আছেন। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এলাকায় রানারও রয়েছে শক্ত অবস্থান। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এ আসনে।
টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনে স্বতন্ত্র (ট্রাক) প্রতিকের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, পাঁচবারের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে মন্ত্রিত্ব হারান। পরে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত হন। এবার ভোটারদের মন জয়ের লক্ষ্যে এ আসনের দুটি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়ন চষে বেড়িয়েছেন। নির্বাচনের মাঠে লতিফ সিদ্দিকীর প্রধান প্রতিপক্ষ তারই রাজনৈতিক শিষ্য কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের ৩২ বছর ধরে সভাপতি ও আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু। ইতিমধ্যে ঠান্ডুর সমর্থকরা জয় পেতে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে বহু আগে যুক্তরাষ্ট্রে বসে মন্তব্য করা হজ ও তাবলীগ নিয়ে করা বক্তব্য ভাইরাল করেছে। তবে সেসব বিষয় পাত্তা দিচ্ছেন না কালিহাতীর লোকজন। এ আসনে বর্তমান এমপি হাসান ইমাম খান সোহেল হাজারী সমর্থিত বহু নেতাকর্মী ও উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগের কতিথ নেতাকর্মিরা লতিফ সিদ্দিকীর সাথে মাঠে কাজ করছেন। এসব কারণে (নৌকার) প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে পড়েছেন। এ আসনে অপর প্রার্থী রয়েছেন স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক সাবেক মন্ত্রী শহাজাহন সিরাজের কন্যা ব্যারিষ্টার সারওয়াত সিরাজ শুক্লা। তিনি স্বতন্ত্র (ঈগল) প্রতিকের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা বাবার ভক্ত অনুরাগী ও সমর্থকদের নিয়ে মাঠ চষে বেড়িয়েছেন। এ আসনে ত্রিমুখী লড়াই হবে।
টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে দুইবারের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছানোয়ার হোসেন এবার মনোনয়ন পাননি। এখানে মনোনয়ন পেয়েছেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অ্যাডভোকেট মামুন অর রশিদ। এখানে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র (ঈগল) প্রতিকের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন ছানোয়ার হোসেন। গত ১০ বছর ছানোয়ার হোসেন এলাকায় উন্নয়ন মূলক কাজ করেছেন। টাঙ্গাইল জেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মিরা প্রকাশ্যে ও গোপনে তার সাথে কাজ করছেন। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর বীরোত্তমের ভাই মুরাদ সিদ্দিকী স্বতন্ত্র (মাথাল) প্রতিকের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারও ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। গত চারটি সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভাল ফলাফল করেছিলেন। এ আসনেও ত্রিমুখী লড়াই হবে।
টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) এই আসনে একাব্বর হোসেন সাতবারের এমপি ছিলেন। তার মৃত্যুর পর উপ-নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খান আহমেদ শুভ। এবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে মনোনয়ন না পেয়ে তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র (ট্রাক) প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মির্জাপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মীর এনায়েত হোসেন মন্টু। এদিকে মন্টুর ছোট ভাই মির্জাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মীর শরীফ মাহমুদ, সাবেক এমপি একাব্বর হোসেনের ছেলে সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার তাহরিম হোসেন সীমান্ত, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মেজর (অঃ) হাফিজ, রাফিউর রহমান ইউসুফজাই সানি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল কালাম আজাদ লিটনসহ অনেকেই নৌকা ঠেকাতে মাঠে নেমেছেন। তারা মন্টুর পক্ষে কাজ করছেন। এখানে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় পেতে হবে নৌকার প্রার্থীকে।
টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন সখীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি অনুপম শাহজাহান জয়। তার বাবা প্রয়াত শওকত মোমেন শাহজাহান এ আসনের একাধিকবার এমপি ছিলেন। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকলেও অনুপম শাহজাহান জয়কে কৃষক শ্রমিক জনতালীগের সভাপতি বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীকে মোকাবেলা করতে হবে। এ আসনের বর্তমান এমপি এডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহেরসহ দুই উপজেলা আওয়ামী লীগের বিশাল একটি অংশ (নৌকা) প্রতিকের প্রার্থী জয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা নির্বাচন থেকে দূরে রয়েছেন। এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি বঙ্গবীরের জনপ্রিয়তার কাছে নৌকা জয়ী হলে চমক হিসেবেই দেখা হবে।
এসব বিষয়ে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খন্দকার আশরাফুজ্জামান স্মৃতি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মার্কা নৌকা। সময় যত গড়িয়েছে ভোটাররা নৌকার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তবে ছয়জন প্রার্থী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও অন্তত ৪টি আসনে নৌকা বিজয়ী হবে বলে আশা করছি। দলের সিদ্ধান্ত মতে যারা নৌকার বিরোধিতা করছে আর যারা নৌকার সাথে রয়েছে তাদের সাথে এই যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টি হলো, এই কোন্দলের এক সময় বিস্ফোরণ ঘটবে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগে। এসব কারনে এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।