শিক্ষিত যুবকদের আগ্রহ বাড়ছে টাঙ্গাইলে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত চাষিরা

কৃষি টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল সদর টাঙ্গাইল স্পেশাল লিড নিউজ

হাসান কিসদার ॥
টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার গালা গ্রামে সরিষা খেতের পাশে মৌ চাষের ১৩০টি বাক্স বসিয়েছেন খলিল গাজী। এ থেকে তিনি ৩০-৩৫ মণ মধু সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আশা করছেন। তিনি জানান, সরিষা খেত থেকে মধু আহরণ করলে পরাগায়ণ হয়। এতে সরিষার উৎপাদন বাড়ে। তাই খেতের মালিকেরাও মৌচাষিদের উৎসাহিত করছেন।
শুধু খলিল গাজী নন, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের সরিষা খেতের পাশে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ চলছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকায় বাক্স বসছে। ১২টি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে হলুদের সমারোহ। গ্রামের মাঠজুড়ে আবাদ হয়েছে সরিষার। ইতিমধ্যে সরিষা থেকে মৌমাছির সাহায্যে মধু সংগ্রহ শুরু হয়েছে। মধু সংগ্রহের কারণে সরিষার ফলনও বাড়ে। সরিষার ফলন ভালো হওয়ায় মধু সংগ্রহ বাড়বে বলে আশা চাষিদের।
মৌচাষি খলিল গাজী মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার সোনাতলা এলাকা থেকে। তিনি বলেন, ১৩০টি বাক্স ৩০ থেকে ৩৫ মণ মধু সংগ্রহ করতে পারব। দেড় মাস এখানে থাকব। দেড় মাসে ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ হবে। ৬-৭ লাখ টাকার মধু বিক্রি করতে পারব। পাইকারি ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা মণ দরে মধু এবার বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০০ টাকা কেজি দরে। মধু সরাসরি কোম্পানিতে দিয়ে থাকি। সব খরচ বাদ দিয়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ করার আশা করছি। তিনি আরও বলেন, মৌমাছির বাক্স বসালে ফলন ভালো হয়। তাই খেতের মালিকেরা বাক্স বসাতে আমাদের সহায়তা করেন। চাকরির ব্যবস্থা বর্তমানে ভালো না। তাই বর্তমানে শিক্ষিত যুবকরা দিন দিন মৌচাষে আগ্রহ বাড়ছে।
মৌ শ্রমিক চয়ন মিয়া বলেন, আমি এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। পরিবার থেকে খরচ দিতে পারে না। চিন্তাভাবনা করে দেখলাম একটা কিছু করতে হবে সেজন্য এখানে কাজ করি। এখানে যে বেতন পাই আমার খরচ রেখে পরিবারকে সব দিয়ে দেই। মৌবাক্সের কাজ শিখতে চলে এসেছি। আমরাও চিন্তা ভাবনা আছে আমিও মৌ বাক্স নিজে উদ্যোগে গড়ে তুলবো। বেকার বসে না থেকে কিছু একটা করা ভালো। যারা শিক্ষিত যুবক আছে তাদের বলবো বসে না থেকে কোন একটা ব্যবস্থা করার। তাহলে দেশে আর বেকারত্ব থাকবে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার ১২টি উপজেলায় চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। জেলায় ৭৯ হাজার ৯৪১ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৮১ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। গত মৌসুমে চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৮ হাজার ১২০ হেক্টর। গত মৌসুমের চেয়ে এবার ২৩ হাজার ৪২০ হেক্টর বেশি সরিষা চাষ হয়েছে। এর মধ্যে মৌ চাষের আওতায় জমি রয়েছে ১৮ হাজার ৮২ হেক্টর জমি। মৌ স্থাপিত হয়েছে ৬ হাজার ৫৯৭ টি। এখন পর্যন্ত মধু আহরণ হয়েছে ৫ হাজার ৯১৭ কেজি। জেলায় এ পর্যন্ত স্থানীয় ৩৪ জন ও অস্থায়ী মৌচাষি রয়েছে ৭৮ জন।

কৃষি বিভাগ সূত্রে আরও জানা যায়, গতবছর কৃষকরা সরিষার ভালো দাম পেয়েছিলেন। এতে লাভবান হয়েছিলেন তারা। এ বছরও অধিক লাভবানের আশায় সরকারি প্রণোদনার পাশাপাশি নিজস্ব উদ্যোগেও অনেক কৃষক সরিষার আবাদ করেছেন। উচ্চফলন ও স্থানীয় উভয় জাতের সরিষা কৃষকেরা চাষ করেন। সরিষা নভেম্বরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আবাদ করতে হয়। ফসল ঘরে উঠতে সময় লাগে জাত ভেদে ৭০-৯০ দিন। জেলার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন সরিষা ফুলের সমারোহ। কৃষকেরা যেমন মাঠে সরিষা পরিচর্যা করছেন। তেমনি খেতের পাশে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন মৌচাষিরা। জেলার ১২টি উপজেলায় সরিষার মৌসুমে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মৌচাষিরা মধু সংগ্রহের জন্য বাক্স নিয়ে এসেছেন। সরিষা ক্ষেতের পাশে মধু সংগ্রহের বাক্স শোভা পাচ্ছে।
খলিল গাজীর ছোট ভাই আল আমিন বলেন, মৌ চাষে খরচ অনেক। বছরে ৭ মাস মধু হয় না। এ সময় মৌমাছিকে বাঁচিয়ে রাখতে চিনি খাওয়াতে হয়। এ বছরের চিনির দামও বেশি। এ বছরের মধু সংগ্রহে লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক আগে থেকে মৌচাষ করছি। সরকার যদি সরাসরি মধু সংগ্রহের ব্যবস্থা করত। তাহলে আমরা সঠিক দামটা পেতাম। এতে আমাদের লাভ হতো বেশি। তিনি আরও বলেন, মৌবাক্স বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। আমি আগে ঢাকায় একটি কোম্পানিতে অল্প টাকায় একটা চাকরি করতাম। ওই বেতন দিয়ে সংসার ভালোভাবে চলতো না। ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমার বড় ভাই খলিল গাজীর সাথে কাজ করি। এখন অনেক সুন্দর ভাবে চলতে পারি। অনেক শিক্ষিত বেকার যুবকরা মৌচাষে আগ্রহ বাড়ছে। যারা আমার মতো আরও বেকার যুবক আছে তাদেরকে বলবো ঘরে বসে না থেকে কিছু একটা করার।
সদর উপজেলার গালা এলাকার জাহিদ মিয়া বলেন, মৌচাষিদের মধু আহরণের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মধু সংরক্ষণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সরকারিভাবে নেওয়া প্রয়োজন। সংরক্ষণ করতে পারলে মৌচাষিরা আরও বেশি লাভবান হতে পারবেন।
টাঙ্গাইলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক দুলাল উদ্দিন বলেন, মৌমাছি সরিষা খেতের ফুলে ঘুরে ঘুরে বসে মধু সংগ্রহ করে। এতে সরিষা ফুলে সহজে পরাগায়ণ ঘটে। তাই সরিষা খেতের পাশে মৌ চাষের বাক্স স্থাপন করলে সরিষা ফলন অন্তত ২০-২৫ শতাংশ বাড়ে। পাশাপাশি মৌচাষিরা মধু আহরণ করে লাভবান হন। সরিষা চাষিরা মধু সংগ্রহকারীদের বাধা না দিয়ে আরও সহযোগিতা করে। নানাভাবে মধু সংগ্রহকারীদের কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে।

১৯৩ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *