
স্টাফ রিপোর্টার, মির্জাপুর ॥
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে মাটি খেকোদের নখর থাবায় তিন ফসলি জমি আবাদ অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবাদী জমির মাটি ১২ থেকে ১৫ ফুট গভীর করে মাটি কেটে নেয়ায় জমি হচ্ছে নদী। এতে বিপুল পরিমান আবাদী জমি কমছে। কৃষিজমি কমায় ধান, আলু, পাট, সরিষা ও সবজিসহ খাদ্যশস্য উৎপাদনে এর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাকিলা বিনতে মতিন ও উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমান দিন-রাত ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান চালিয়ে জেল জরিমানা ও ডাম্পট্রাক, ভেকু জব্দ করলে থামছে না মাটি কাটা।
রাজনৈতিক একটি মহলের ছত্রছায়ায় এ উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়নের অর্ধ শতাধিক স্থানে মাটি কাটার মহোৎসব চলছে। মাটি ব্যবসায়ীদের কাছে প্রশাসন ও উপজেলাবাসী যেন নিরুপায় হয়ে পড়েছেন।
মাটি ভর্তি অভারলোডের ভাড়ি ডাম্প ট্রাক চলাচল করায় গ্রামের রাস্তা ও বিভিন্ন আঞ্চলিক পাকা সড়ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবাদী ফসল, সবজি খেত ও রাস্তার পাশের বাড়িঘর ধুলায় ঢেকে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এভাবে দ্রুত কৃষিজমি কমতে থাকলে এক পর্যায়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা মেটানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অর্ধশতাধিক স্থানে সরকার দলীয় প্রভাবশালী কতিপয় নেতাদের ছত্রছায়ায় বেপোরোয়াভাবে এই মাটি কাটা হচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
মাটি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসন বারবার অভিযান পরিচালনা করলেও তাদের রুখতে পারছেন বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। সবচেয়ে বেশি তিন ফসলি জমির মাটি কাটা হচ্ছে এ উপজেলার গোড়াই, ফতেপুর ও বানাইল ইউনিয়নে।
জানা গেছে, এ উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৪ ইউনিয়নে প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর জমিতে ধান, ২০ হাজার হেক্টরে সরিষা ও সবজির আবাদ হয়। এ উপজেলায় উৎপাদিত ফসল উপজেলার চাহিদা মিটিয়েও অন্য উপজেলায় সরবরাহ করা হয়। প্রতি বছর আবাদী জমির মাটি ১২ থেকে ১৫ গভীর করে কেটে নেয়া হয়। ফলে চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে আবাদী জমি নদী হচ্ছে। এতে বিপুল পরিমান আবাদী জমিই কমছে না ফসলের ঘাটতিও হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই এ উপজেলার গোড়াই ইউনিয়নের পাথালিয়াপাড়া, ফতেপুর ইউনিয়নের থলপাড়া ও বানাইল ইউনিয়নের মাঝালিয়া এলাকায় তিন ফসলী জমির মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে।
এছাড়া উপজেলার গোড়াই ইউনিয়নের রশিদ দেওহাটা, মমিননগর, লতিফপুর ইউনিয়নের যোগীরকোফা ও ত্রিমোহন ফিরিঙ্গিপাড়া মৌজার বংশাই নদীর পার ভেকু মেশিনের মাধ্যমে কেটে শত শত ডাম্পট্রাক দিয়ে মাটি নেয়া হচ্ছে। মাটি ভর্তি অভারলোডের ভাড়ি ডাম্প ট্রাক চলাচল করায় গ্রামের রাস্তা ও বিভিন্ন আঞ্চলিক পাকা সড়ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবাদী ফসল, সবজি খেত ও রাস্তার পাশের বাড়িঘর ধুলায় ঢেকে যাচ্ছে।
একইভাবে এ উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের বংশাই নদীর চাকলেশ^র, থলপাড়া, বৈলানপুর ও পারদিঘী ব্রিজ উত্তর পাশ পর্র্যন্ত অন্ততপক্ষে ১০টি স্থানে ভেকু মেশিন দিয়ে নদীর পার ও ৬টি ড্রেজার মেশিন দিয়ে নদী কেটে মাটি লুট করা হচ্ছে।
এছাড়া জামুর্কী ইউনিয়নের গুনটিয়া, চুকুরিয়া, ভুষুন্ডি, বাদশা বাড়ির কুম এলাকায় লৌহজং নদী থেকে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি লুট করা হচ্ছে। একইভাবে এ উপজেলার বহুরিয়া ইউনিয়নের গোহাইলবাড়ী আনালবাড়ী, বুধিরপাড়া, বানাইল ইউনিয়নের মাঝালিয়া গ্রামের ফসলী জমি থেকে মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে। এছাড়া উয়ার্শী নদী থেকেও রাতের আধারে মাটি কাটা হচ্ছে বলে জানা গেছে। পৌর এলাকার বাওয়ার কুমারজানী বংশাই নদীর পাড়ে হাতেম টাউন এলাকা থেকে প্রতিরাতে মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন।
ফসলী জমির মালিকগণ নিরুপায় হয়ে নামমাত্র মূল্যে মাটি বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে ভূক্তভোগীরা জানিয়েছেন। উপজেলা প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও কিছু সময়ের জন্য মাটিকাটা বন্ধ থাকলেও প্রশাসনের লোক চলে গেলেই মাটি কেটে নেয় বলে এলাকার জনগণ জানিয়েছেন।
এভাবে মাটি লুটের দরুণ নদীর পারের অস্তিত্ব বিলীন হচ্ছে। ওই সমস্ত এলাকায় মাটি লুটের কারণে প্রতিবছর ভয়াবহ নদী ভাঙ্গন হয় এবং আগামীতেও ভাঙ্গনের আশঙ্কা রয়েছে বলে ফতেপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ইব্রাহিম মিয়াসহ অনেকেই জানিয়েছেন।
এসব ট্রাক এবং ভেকু মেশিনের ঘরঘর শব্দে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর রাতের ঘুমও হারাম হয়েছে বলে মাঝালিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান মতি জানিয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাথালিয়াপাড়া এলাকার ফসলী জমি থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কেটে নদী বানানো হচ্ছে।
পাথালিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষাক আলমগীর হোসেন জানান, ভাড়ি ট্রাক চলায় রাস্তার পাশর্^বর্তী বসতবাড়ী ও ফসলী জমিতে ধুলোর আস্তর পড়ছে। আবাদকৃত ফসল নষ্ট হওয়া ছাড়াও ওই এলাকার বৃদ্ধ এবং শিশু কিশোররা শ^াসকষ্টসহ নানা রোগ ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন।
বহুরিয়া গ্রামের কৃষক সুলতান মিয়া ও আসাদ মিয়া জানান, বর্গা নিয়ে তারা প্রায় ১০০ শতাংশ জমিতে সরিষার আবাদ করেছেন। জমির মালিক মাটি বিক্রি করায় অপরিপক্ক সরিষা তুলে ফেলতে হচ্ছে। এতে অনেক ক্ষতি হবে।
গোড়াই ইননিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার লিটন মিয়ার সাথে কথা হলে তিনি জানান, তার এলাকা পাথালিয়াপাড়ায় মাটি কাটা বন্ধের জন্য তিনি গত বছর উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্থানে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
গোড়াই ইউপির চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর জানান, মাটি লুটের তালিকা করা হচ্ছে। ওই তালিকা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে জমা দেয়া হবে।
মির্জাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার পাল জানান, এ উপজেলায় উৎপাদিত ফসল উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে অন্য উপজেলায় সরবরাহ করা হয়। যেভাবে ফসলী জমি থেকে মাটি কেটে নদী বানানো হচ্ছে তাতে আগামীতে মির্জাপুরে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকীর মুখে পড়বে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। ।
এ ব্যাপারে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি জানান, প্রতি নিয়তই ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান চালানো হচ্ছে। অবৈধভাবে মাটি লুটের বিরুদ্ধে প্রশাসনের সাথে এলাকাবাসীকেও এগিয়ে আসতে হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাকিলা বিনতে মতিন জানান, মাটি লুটেরাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত এক সপ্তাহে ৬টি ভেকু মেশিন, ১২টি ড্রাম ট্রাক, একটি লোভেট ও একটি ড্রেজার জব্দ করা হয়েছে। বিভিন্ন মাটি লুটেরার কাছ থাকে প্রায় ১২ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।