অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে ভাগ্য বদল নারী উদ্যোক্তাদের

টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল সদর টাঙ্গাইল স্পেশাল তথ্য ও প্রযুক্তি লিড নিউজ

হাসান সিকদার ॥
টাঙ্গাইল জেলায় অনলাইন ভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা দিন দিন বাড়ছে। গত তিন-চার বছর ধরে পোশাক, আচার, কেকসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য, অর্গানিক অয়েল, কসমেটিক্স, জুয়েলারী, কসাপিতলের জিনিসপত্র, মাটির তৈরি জিনিসপত্র, পাটের তৈরি জিনিসপত্রসহ নানান পণ্যের ব্যবসা জনপ্রিয়তা হয়ে উঠছে। অনেক নারীই আগ্রহী হয়ে উঠছেন ডিজিটাল প্লাটফর্ম উইমেন এন্ড ইকমার্স ট্রাস্ট ফোরাম (উই) ফেসবুক ভিত্তিক পেইজে যুক্ত হয়ে ব্যবসা পরিচালনার জন্য। এতে ঘরে বসেই পরিবারের কাজের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের সুযোগ পাচ্ছেন নারীরা। অল্প পুঁজিতে নারীরা অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে নিজেরা সফলও হয়েছেন। মাসে কেউ কেউ ৮০ হাজার টাকা বা এক লাখ টাকা আয় করছেন। জেলায় প্রায় দুই শতাধিক নারী উদ্যোক্তা এমনিভাবে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছেন। দিন দিন এদের সংখ্যা বাড়ছে।
স্থানীয়ভাবে মূলত অনলাইনে মানুষের খাদ্য পণ্য ও পোশাকের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। অনলাইনে অর্ডারের পর নির্ধারিত সময়ে ক্রেতার পছন্দনীয় পণ্য দরজায় পৌঁছে যায় বিশ্বস্ততায়। গত দুই-তিন বছরে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ বেড়েছে। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে অনেক নারীই ঘরে বসে উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেন। যা বর্তমানে নারী উদ্যোক্তারা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা। যেসব উদ্যোক্তা নারীরা কিছু একটা করতে চায় অনলাইন প্লাটফর্ম তাদের জন্য দারুণ একটা সুযোগ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলার সখীপুর উপজেলার নারী উদ্যোক্তা সানজিদা আহমেদ জুই একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে জেলা ও জেলার বাইরে বেশ পরিচিত রয়েছে। জুই বলেন, আমার ছোট বেলা থেকে ইচ্ছে ছিল পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু একটা করবো। কোথাও চাকরি করলে তো অন্যের অধিনে কাজ করতে হয়। আমার চিন্তাভাবনা ছিল অন্যের অধিনে কাজ না করে নিজে নিজে কিছু একটা করবো অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবো। বিগত ২০২০ সালের দিকে করোনা আসলো ঘরে বসে থেকে আর ভালো লাগে না। পরে উই নাম একটি ফেসবুক গ্রুপ দেখতে পেলাম। তখন মাথায় চিন্তা আসলো কি নিয়ে কাজ করা যায়। সবাই তো খাবার, বিভিন্ন আচার, পোশাক নিয়ে কাজ করে, তাহলে আমিও করবো। আমার স্বামী ও বাবা-মার কাছে পরামর্শ নিয়ে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে কাথাসহ ছোট বাচ্চাদের পোশাক নিয়ে কাজ শুরু করলাম। রুহি’র মম নামে একটি ফেসবুক পেইজ খুললাম। প্রথম দিনই অর্ডার আসলো তাও আবার অন্য জেলা থেকে প্রথম বিক্রি ছিল মাত্র ৫০০ টাকা। আরও কাজের প্রতি উৎসাহী হলাম। এরপর থেকে শুরু হলো কাজ করা। অনলাইনে আমার ৯৫ ভাগ বিক্রি হয় আর ৫ ভাগ অফলাইনে বিক্রি হয়। প্রতি মাসে আমার ৭০-৮০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয়। লাভ থাকে প্রায় ৩০-৪০ হাজার টাকার মতো। এখানে বর্তমানে প্রায় ৫০ নারী কর্মী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। আমার এক মেয়ে ও সংসারের সময় দেয়ার পর বাকি সময়টুকু ফেসবুক দেয়। এতে আমিও সফলতা পাচ্ছি আরেকদিকে আমার সাথে যারা নারী কর্মীরা কাজ করে তাদের সংসার সামলিয়ে আমার এখানে কাজ করে সফলতা পাচ্ছে।
এসবের জন্য ‘রুহি’স মম’ নামক পেইজ খোলা হয়েছে। বর্তমানে বেশ সাড়া পাচ্ছেন এ উদ্যোক্তা। অনলাইনে অর্ডারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলায় পণ্য পাঠান তিনি। নারী উদ্যোক্তা জুই আরও বলেন, আমি নকশি কাথা, সরিষার বালিশ, শিমুল তুলার বালিশ, ফ্যামেলি কম্বো ড্রেস, পাটের ব্যাগ, হাতের কাজের জুয়েলারিসহ বিভিন্ন রকমের পণ্য নিয়ে কাজ করি। আমি মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় ও বিসিক থেকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন স্মার্ট নারী উদ্যোক্তা গ্রান্ট। সরকার থেকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছে। তবে অনলাইনে নারীদের ব্যবসার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মানসিকতা থাকতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
পৌর শহরের পশ্চিম আকুর-টাকুর পাড়া এলাকার নারী উদ্যোক্তা নাহিদা ইসলাম বলেন, বিগত ২০১৮ সালে দিকে পোশাক নিয়ে কাজ করি ভালোই চলছিল। তারপর আমার বাচ্চা হলো তখন ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ঘরে বসে থাকতে আর ভালো লাগছিলো না। চিন্তা করতে থাকি কি করবো। তখন আমার স্বামী ও আমার ননদ বলে তোমার রান্না অনেক ভালো। খাবার নিয়ে আবার শুরু করো গত দুই বছর যাবত অনলাইনে বিভিন্ন খাদ্যপণের ব্যবসা করেছি। তিনি বলেন, দুই বছর আগে করোনার মধ্যে অনেকের দেখাদেখি আমিও অনলাইনে যুক্ত হয়ে জোড়ালোভাবে ব্যবসা শুরু করলাম। বর্তমানে সংসারে কাজের ফাঁকে আমি সব ধরনের বাংলা খাবার, চিকেন ফ্রাই, বিফ কারি, ভেজিটেবলস, সালাদ, বিভিন্ন ধরনের বিরিয়ানী, পোলাউ, শর্মাসহ অর্ডার মোতাবেক বিভিন্ন মজাদার খাবার তৈরি করি। বিয়ে অনুষ্ঠানসহ বিভিন্নে অনুষ্ঠানে খাবারের অর্ডার নিয়ে থাকি।

এই নারী উদ্যোক্তা আরও বলেন, বিশেষ করে বার্থডে, মিলাদসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে আমার এসব খাদ্য পণ্যের বেশ চাহিদা রয়েছে। এছাড়া মেয়ে-জামাই বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য পিঠাসহ অনান্য খাবারও এখান থেকে ডালা করে সাজিয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা রয়েছে। কাজ করতে পারলে প্রতিমাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে পরিবারের সহায়তা বেশি প্রয়োজন।
অর্গানিক প্রোডাক্ট বিডি’র স্বত্বাধিকারী ও কলেজ ছাত্রী ঋতু বর্ণা বলেন, আমি গত তিন বছর ধরে লেখাপড়ার পাশাপাশি অনলাইনে অর্গানিক হেয়ার অয়েল, অর্গানিক হেয়ার প্যাক, অর্গানিক ক্রিম, অর্গানিক বডি লোশন ও ঝাল মুড়ির মসলার ব্যবসা করছি। ভালোই সাড়া পাচ্ছি। আমাদের ‘উইমেন এন্ড ই-কমার্স ট্রাস্ট ফোরাম (উই) নামে একটি গ্রুপ রয়েছে ফেইজবুকে যার সদস্য ১ মিলিয়নের উপরে। এটা আমাদের অনলাইনে ব্যবসার একটি বড় প্লাটফর্ম। এর মাধ্যমে অনেক বিক্রেতারাই পণ্য বিক্রি করছেন সহজে। আমাদের নিজস্ব ফেসবুক পেইজে পণ্যের ছবি দিয়ে থাকি ওখান থেকেও ভালো সাড়া পাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, বর্তমান সময়ে অধিকাংশ মানুষই অনলাইনের প্রতি ঝুঁকছেন, এতে এ খাত আরো বড় হচ্ছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি অনলাইন থেকে বাড়তি আয় হচ্ছে। বর্তমানে আমার মতো অনেক ছাত্রী অনলাইনে ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছেন। আমাদের যদি সরকারিভাবে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয় তাহলে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারবো। চাকরি পিছনে না ছুটে নিজেরাই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবো।
উই’র টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি ও স্বত্বাধিকারী ‘স্বপ্নের সন্ধানে’। মাহবুবা খান জ্যোতি বলেন, বাসায় স্বামীকে খাওয়ানোর জন্য আচার করে সেই ছবি ফেসবুকে দেন জ্যোতি। আর সেখান থেকেই অর্ডার পান বেশ কয়েক ধরনের আচারের। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জ্যোতির। জ্যোতি মাত্র ২৬০ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে এখন প্রতি মাসে প্রায় লাখ টাকা আয় করছেন। সংসার সামলেও ব্যবসায়ীর খাতায় নাম লিখিয়েছেন এক সন্তানের জননী এই নারী উদ্যোক্তা। বর্তমানে তিনি টাঙ্গাইল পৌর শহরের পূর্ব আদালত পাড়া এলাকার একজন পরিচিত মুখ। জ্যোতির কাছে মিলবে পছন্দ অনুযায়ী ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যকর কেক, বিভিন্ন রকমের আচার, আমসত্ত্ব, হাতের তৈরি ডিজাইনের শাড়ি, পাঞ্জাবি ও বাচ্চাদের ফতুয়া। খাবারসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কাজ করছেন তিনি।
জ্যোতি বলেন, আমাদের দেশের মেয়েরা বিয়ের পর সেভাবে এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন না, এমন ধারনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আজ তিনি একজন সফল নারী। প্রায় দেড় মাসে হয়ে গেছেন লাখপতি। ঘরে বসেই তিনি মাসে আয় করছেন প্রায় লাখ টাকা। পড়াশোনা চলাকালীন বিয়ে হয়ে যায় জ্যোতির। তার স্বামী বর্তমানে মেরিনার ইন্টারন্যাশনাল শিপ এ কর্মরত আছেন। এরপর এক বাচ্চা ও সংসার সামলে কোন চাকরিতে যোগদান করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল নিজে কিছু করবেন। সময়-সুযোগের অভাবে কিছু করা হয়ে ওঠে নাই। এক মেয়ে একটু বড় হওয়ার পর ভাবলেন কিছু একটা করা উচিত। সে অনুযায়ী বিগত ২০২০ সালের প্রথম দিকে জয়েন করেন ‘উই’ নামক একটি ফেসবুক গ্রুপে। জ্যোতি ভরসা করেন উইতে। গ্রুপটিতে যুক্ত হওয়ার পর জানতে পারেন ক্ষুদ্র ব্যবসার ইতিবৃত্ত। বিগত ২০২০ সালের জুন মাস থেকে কাজ শুরু করেন। নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করতে শুরু করেন আচার, আমসত্ত্ব। ইতোমধ্যে তার আমসত্ত্ব সাড়া ফেলেছে টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলা ও দেশের বাইরেও। আমসত্ত্ব, আচারের গুণগত মান নিয়ে সন্তুষ্ট তার ভোক্তারা। তাই অর্জন করেছেন টাঙ্গাইলে আমসত্ত্ব জ্যোতি খেতাব। ক্রেতাদের কাছ থেকেই পেয়েছেন এ নাম। তবে টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলা ও বিদেশে ডেলিভারি দিয়ে থাকেন তিনি। এটাকে আরও প্রসারিত করার চিন্তা তার। তিনি আরও বলেন, আমাদের টাঙ্গাইলে প্রায় ২২০ জন নারী উদ্যোক্তা কাজ করছেন। বিসিক থেকে আমাদের ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। নারী উদ্যোক্তাদের বিসিকি থেকে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে থাকেন।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল জেলা বিসিক কার্যালয়ের শিল্প নগরী কর্মকর্তা জামিল হুসাইন বলেন, দিন দিন টাঙ্গাইলে নারী উদ্যোক্তা বাড়ছে। নারীরা অনলাইন ভিত্তিক বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত হয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তাদেরকে বিসিক থেকে ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। এছাড়াও ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করানো হয়। যারা নতুন উদ্যোক্তা হতে চান তাদেরকে আমরা উৎসাহিত করি।

১৭১ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *