
হাসান সিকদার ॥
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় চলতি মৌসুমে আনারসের বাম্পার ফলন হয়েছে। রসে ভরা টস-টসে আনারস দেখে কৃষকের মুখেও ফুটেছে হাসির ঝলক। রসে ভরা এ আনারস ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাজার দখল করে নিয়েছে। তাই তো দিনদিন বাড়ছে আনারসের আবাদ। ক্যালেন্ডার ও জলডুগি এ দুই জাতের আনারসের আবাদ করেন এ উপজেলার চাষিরা। জুন-জুলাই মাসে এ আনারস বাজারজাত করা হয়। তবে রমজান মাস সামনে রেখে মার্চ মাসেই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে জলডুগি আনারস।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে মধুপুরে ৬ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আনারস আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৩২৪ হেক্টরে জলডুগি এবং ৬ হাজার ৫১০ হেক্টরে ক্যালেন্ডার প্রজাতির আনারস আবাদ হয়েছে। এছাড়াও পরীক্ষামূলকভাবে এমডি-টু জাতের আনারস আবাদ হয়েছে ৬ হেক্টর জমিতে। প্রাকৃতিকভাবে আনারস গুটি ধরা থেকে পাকা পর্যন্ত ছয় থেকে সাত মাস সময় লাগে। জলডুগি আনারস চারা রোপণ থেকে পাকা পর্যন্ত সময় লাগে ১২ মাস। আনারস জুন-জুলাই মাসে বাজারে আসার কথা থাকলেও মার্চেই বিক্রি শুরু হয়েছে।
কৃষি অফিস সূত্রে আরও জানা যায়, বর্তমানে মধুপুরে ২৬টি পাইকারি ও ১৬২টি খুচরা রাসায়নিক বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান আছে। দেশি, বিদেশি ও স্থানীয় ৭০টি কোম্পানির রাসায়নিক উপজেলায় বিক্রি হয়। চাষিদের একটি সূত্র জানায়, অধিক লাভের আশায় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করে অসময়ে এ জাতের আনারসকে পাকিয়ে বাজারে বিক্রি করছেন। এতে ভিটামিন ও খনিজ লবণসমৃদ্ধ এই ফলকে ‘বিষে’ পরিণত করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা আনারস খেলে অ্যালার্জি, চর্মরোগ থেকে শুরু করে ক্যানসারেও আক্রান্ত হতে পারে মানুষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অধিক লাভের আশায় কৃষক ও অসাধু ব্যবসায়ীরা মিলে আনারসের চারায় গুটি ধরা, বড় করা ও পাকানোর কাজটি করছেন রাসায়নিক দিয়ে। ৪৫ পাতা হওয়ার পর আনারসের চারায় গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করা যায়। কিন্তু কিছু চাষি ১২-১৫ পাতা হওয়ার পরই তা ব্যবহার করছেন। অপর দিকে ১৬ লিটার পানিতে ১৬ মিলিগ্রাম রাসায়নিক মিশিয়ে চারায় স্প্রে করার কথা কৃষি বিভাগ জানালেও কৃষকেরা ১৬ লিটারে দুই থেকে তিন’শ মিলিগ্রাম ব্যবহার করছেন।
সরেজমিনে মধুপুর উপজেলার কুড়িবাড়ী, হাগুড়াকুড়ি, শোলাকুড়ি, ঘুঘুর বাজার, গায়রা ও ইদিলপুর গ্রামে ঘুরে বিভিন্ন বাগানে দেখা যায়, শ্রমিকরা আনারসে রাসায়নিক ছিটাচ্ছেন। কৃষক ও শ্রমিকরা জানায়, দ্রুত পাকানোর জন্য শুধু ইথোপেন রাসায়নিক স্প্রে করা হচ্ছে খেতে। আনারস চাষি শুকুমার বলেন, আনারস গাছে কোন দিনই একসাথে সব গাছে ফল ধরবে না। কিছু কিছু গাছে ফল ধরবে ও পাকপে। ওই আনারস খাইতে স্বাদ বেশি, মিষ্টিও বেশি। শেয়ালসহ বিভিন্ন পশু-পাখি আনারস খেয়ে ফেলে এজন্য আরও বেশি ক্ষতি হয়। তিনি আরও বলেন, আনারসের চারা বড় হলে গাছের মাথায় গর্ভবতী (রাসায়নিক) দিলে কয়দিন পরেই সব গাছে গুটি ধরে। যে গাছে গুটি ধরে না সেই গাছে আবার গর্ভবতী দিলেই গুটি বাইর হয়। তারপর ১৫-১৬ দিন পরপর দুই থেকে তিনবার হরমোন দেই। আনারস বড় হয়। পাকানোর ওষুধ দিলে ঝাত একবারে পাকে। এক দিক থেকে কাটি আর বিক্রি করি।
শ্রমিক আব্দুস সামাদ ও হায়দার আলী বলেন, ১৬ লিটার পানির কনটেইনারে দুই থেকে তিন বোতল রাসায়নিক মিশিয়ে আনারসে স্প্রে করছি। সাত দিনের মধ্যেই সুন্দর কালার হয়ে পেকে যায়। কয়দিন আগে যে আনারসে ওষুধ দিছি ওইগুলো খেতেই বিক্রি হচ্ছে। আনারস ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন বলেন, মধুপুরে প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার আনারস বেচাকেনা হয়। বর্তমানে আনারস ২০-২৫ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। আর ৩-৪ দিনপর রমজান মাস আনারস বিক্রি বেশি হবে। তখন আনারসের দাম আরও বাড়তে পারে। আরেক ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ৯০ লাখ টাকা দিয়ে ৩ লাখ ৭০ হাজার আনারস কিনেছি। সেই আনারসগুলো বাজারজাত শুরু করেছি। ঢাকা, উত্তরবঙ্গসহ বিভিন্ন জেলায় আনারস বিক্রি হচ্ছে। জলডুগি প্রতিটি আনারস খেতেই বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকা দামে। রোজা শুরু হলে আনারসের টান বেশি থাকবে। তখন আনারস খেতেই বিক্রি হবে ৩০-৩৫ টাকা দামে।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক কৃষিবিজ্ঞানী ড. আবু হাদী নূর আলী খান বলেন, আনারসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ লবণ থাকে। এতে বিভিন্ন নামের রাসায়নিক ব্যবহার হচ্ছে। হরমোন বা ইথোপেন মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এগুলো ভারত-চীন থেকে আসে। বাংলাদেশে যখন এই রাসায়নিক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয় তখন আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম অনুমোদন না দেওয়ার জন্য। ক্ষতিকর এই রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে অ্যালার্জিসহ নানা চর্মরোগ, বদহজম, গ্যাস্ট্রিক, ক্যানসার হয়ে থাকে।
এ বিষয়ে মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল বলেন, মধুপুরের আনারস খেতে খুব সুস্বাদু। ক্যালেন্ডার ও জলডুগিসহ বিভিন্ন জাতের আনারসের চাষ করছেন কৃষকরা। এছাড়াও বিদেশী এমডি-টু জাতের আনারসের চাষ করছেন। অনেকে আনারস পাকানোর ওষুধ ব্যবহার করে ক্ষতির মুখে পড়ছেন।