হাবিবুর রহমান ॥
টাঙ্গাইল শহরের আড়ংয়ের শো রুমে হরদম বেচাকেনা চলছে। বুধবার (৩ এপ্রিল) দুপুরে দেখা যায় এই আউটলেটে পা ফেলার যেন জায়গা নেই। একই অবস্থা অন্যান্য দেশী ফ্যাশন হাউজের শো-রুমে। টাঙ্গাইল শহরের ক্যাপসুল মার্কেটের পাশে ছোট্ট একটি জুয়েলারি অলঙ্কারের দোকান। অন্তত ১০ জন নারী ভিড় জমিয়েছেন। সোনালি রঙের বালা, পাথরের আংটি ও নেকলেসসহ রংবে রঙের চুরি দেখছেন ও কিনছেন। পাশের একটি ইমিটেশনের দোকানে ইমিটেশনের চুরি নিয়ে দরদাম চলছিল। সোনালি রঙের এই চুরি ১৬০০ টাকা চেয়ে বসে দোকানি। পরে সেটি এক হাজারে রফা হয়। একই অবস্থা কাপড়ের দোকানগুলোতেও। সব মিলিয়ে জমজমাট এবারের টাঙ্গাইলের ঈদ বাজার।
ক্রেতারা বলছেন, এবার রোজায় স্কুল খোলা ছিল। যে কারণে বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়েছে। শপিংয়ে আসা হয়নি। গত (২১ মার্চ) স্কুলগুলো বন্ধ হওয়ায় এবার শপিংয়ে সময় দেওয়া যাচ্ছে। গ্রামে ঈদ করতে যারা আগেভাগে টাঙ্গাইল ছাড়বে তারাও শপিংয়ে বেশি সময় দিচ্ছেন।
সরেজমিন বুধবার (৩ এপ্রিল) শহরের বিভিন্ন মার্কেট ও শপিং সেন্টারে গিয়ে দেখা যায় তিল ধারণের জায়গা নেই। ক্যাশ কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন। নারীরা ব্যস্ত স্যান্ডেল আর সেমিজ কেনায়। পুরুষদের দেখা যায় পাঞ্জাবি ও ফতুয়া দেখতে। তবে জুয়েলারি আইটেম কম কিনতে দেখা গেছে। ব্যাগের দোকানে ভিড় জমানো নারীরা জানান, এবার ঈদে যে রঙের শাড়ি ও সালোয়ার পরা হবে, সে রং অনুযায়ী ব্যাগ কিনতে হচ্ছে। আড়ংয়ে সর্বনিম্ন ৬০০ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে হাতব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে চামড়ার ব্যাগ সর্বনিম্ন তিন হাজার টাকা বলে জানায় আড়ং বিপণন কর্মীরা। শাড়ির বক্সের সামনেও রয়েছে ভিড়। দাম সম্পর্কে বিপণন কর্মীরা জানান, এবার ঈদে আড়ংয়ে সর্বনিম্ন জামদানির দাম ১০ হাজার টাকা। আর সর্বোচ্চ দাম ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা পর্যন্ত আছে। প্রতিদিনই এসব শাড়ি কিনছেন ক্রেতারা। এছাড়া অন্যান্য যে শাড়ি রয়েছে তার মূল্য কম হলেও ৫ হাজারের নিচে নয়।
এবার ঈদ সামনে রেখে জুয়েলারির বাজারও বেশ ভাল। সব দোকানেই রয়েছে ক্রেতার চাপ। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলতেও অন্তত ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। বিক্রেতারা জানান, প্রতিবারের মতো এবারো ভারতীয় জুয়েলারির চাহিদা বেশি। অনেক ক্ষেত্রে এক সেট আবার আলাদা আলাদাও বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন আইটেম। দেখা যায়, ৫টি আইটেম মিলে একটি সেট। এর মধ্যে নেকলেস, সিতাহার, চোকার, বিটস মালা ইত্যাদি রয়েছে। বিক্রেতা মিনা আক্তার জানান, এসব সেট বিক্রি করা হচ্ছে ১০ হাজার টাকায়। কিন্তু দরদামের সুযোগ থাকায় কাস্টমারদের কাছে ১৬ হাজার টাকা দাম হাঁকা হয়। ভারতীয় জুয়েলারির ফিনিশিং ভাল হওয়ায় ক্রেতাও লুফে নিচ্ছে।
ভারতীয় পণ্য নকল করে চীনা পণ্যে বাজার সয়লাব। দেশে এক সময় ভিয়েতনাম ও থাই অলঙ্কার বেশি কেনাবেচা হতো। ইদানীং ভিয়েতনাম ও থাই অলঙ্কার আসছে না। সেই বাজার দখল করেছে চীনা অলঙ্কার। তবে এসব অলঙ্কারের মান সুবিধার না হলেও ডিজাইন ভাল ও দামের কারণে ক্রেতা আকৃষ্ট করা সহজ হচ্ছে। এর বাইরে দেশী অলঙ্কারের চাহিদাও রয়েছে। ঈদ সামনে রেখে চুরি, টপস, স্টোটেনের ডায়মন্ড কাটের চুরি, মিনা কারি ঝুমকা, টার্কি মালাতে ভাল সারা ফেলেছে। শহরের ভিক্টোরিয়া রোডের জুতার ব্রান্ড বাটার শো রুম চোখে পড়ে। সেখানে অবশ্য বেশি ক্রেতা চোখে পড়েনি। বিপণনকর্মীরা জানান, ঈদ উপলক্ষে জুতা-স্যান্ডেলের বেচাকেনা রমজানের শেষের দিকে শুরু হয়। এখন স্বাভাবিক বেচাকেনা হচ্ছে যাকে ঈদ বাজার বলা যাবে না। তবে ক্রেতা নতুন মডেল দেখতে আসছেন বলে জানান। অন্য একটি শোরুমে গেলেও নতুন কিছু জুতা, স্যান্ডেল ও লোফার দেখা গেছে। দোকানের স্বত্বাধিকারী জানান, ঈদের কিছু জুতা-স্যান্ডেল এসেছে। বাকিটা চলে আসবে। প্রতি ঈদেই লোফারের চাহিদা থাকে বেশি। এবার একজোড়া ভালমানের লোফার ৩-৫ হাজার টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
দর্জি পাড়ায় অর্ডার নেওয়া বন্ধের পথে হলেও থান কাপড়, থ্রিপিচের বিক্রি এখনো চলছে। বিপণন কর্মীরা জানান, এবার ভারতীয় ও পাকিস্তানি কাপড়ের পাশাপাশি দেশী কাপড়ও বিক্রি করছেন তারা। দোকানে কাস্টমারের আনাগোনাও ভাল দেখা গেছে। তারা জানান, গতবারের চেয়ে এবার দাম একটু বেশি, কিন্তু কেনাবেচা আলহামদুলিল্লাহ। টাঙ্গাইল শহরের হীরা সুপার মার্কেট, টাঙ্গাইল প্লাজা, আজিজ মার্কেট, নিউ সমবায় মার্কেটে সকাল থেকেই ছিল প্রচন্ড ভিড়। জামা-প্যান্ট ও নারীদের বিভিন্ন ড্রেস বেচাকেনায় বিক্রেতার দম ফেলার সময় নেই। তবে ঈদকে কেন্দ্র করে এখনো জমে উঠেনি কসমেটিক্সের বাজার। কারণ হিসেবে দোকানিরা বলছেন, কসমেটিক্স সবার শেষে কেনা হয়। কারণ নেইল পলিশ থেকে লিপস্টিক সবই রং মিলিয়ে কেনেন নারীরা। এছাড়া শেষ মুহূর্তে মেহেদীর একটি বড় বাজার রয়েছে। সেরাম, উপটানসহ বিভিন্ন রং ফর্সার প্রসাধনী ও মেকাপ ঈদ কেন্দ্র করে বিক্রি বেড়ে যায়।
এবার ঈদের ছুটির সঙ্গেই পালন করা হবে পহেলা বৈশাখ। যে কারণে সব ধর্মের মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। দুই উৎসব মিলে ব্যবসায়ীরাও পেয়েছেন বিক্রির উপলক্ষ। বেচাকেনার বড় প্রস্তুতিও সেরেছে ফ্যাশন হাউজগুলো। দেশী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফ্যাশন হাউজগুলোতে এবার ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোদমে হবে, এমন প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। উদ্যোক্তারা বলছেন, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বড় এ উৎসবে শাড়ি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, জামা, জুতা থেকে শুরু করে গাড়ির মতো বিলাসী পণ্যের ব্যবসাও চাঙা হয়। এছাড়া একশ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বছর বছর এ অর্থনীতির আকারও বড় হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এবার ঈদ কেন্দ্র করে এই সময়ে অর্থনীতির আকার দাঁড়াবে আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি।
এসব বিষয়ে ফ্যাশন উদ্যোক্তারা বলেন, ঈদের সঙ্গে এবার বৈশাখ খুব বড় বেচাবিক্রির প্রত্যাশার জায়গা তৈরি করেছে। কয়েক বছর বৈশাখ রোজার মধ্যে হয়েছে, এবার সেটা ঈদের পর পর। সে কারণে ভালো বেচাকেনা হবে। এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ চাহিদা এসেছে তাতে বাজার ভালো হবে মনে হচ্ছে। আমাদের প্রস্তুতি এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় ভালো। শহরের আকুরটাকুর পাড়ার এলাকার বিভিন্ন শো-রুমের বিপণন কর্মীরা জানান, ঈদ সামনে রেখে ছেলেদের পাঞ্জাবি ও মেয়েদের পার্টি ড্রেস বেশি চলছে। গরমের বিষয় মাথায় রেখে আরামদায়ক পোশাক ও দেশীয় ভাবধারার পোশাকের চাহিদা ভালো লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতার পাশাপাশি গত কয়েক দশকে মানুষের মধ্যে সচেতনতা এসেছে। পাশাপাশি ‘বিদেশী পোশাক মানে ভালো’ এ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছেন ক্রেতারা। দুটি উৎসব একত্রে সে কথা মাথায় রেখেই ফ্যাশনে নতুনত্ব আনার লক্ষ্যে ডিজাইনাররা কাজ করেছেন। এখনো প্রতিদিন নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক আসছে। ঈদের প্রস্তুতির এখন শেষ সময়। সব মিলে যেমন বোঝা যাচ্ছে, এবার ঈদ ভালো যাবে।