হাসান সিকদার ॥
নাম মেহেদী হাসান। পিতার নাম আয়নাল হক। তারা দুই ভাই, এক বোন। তার বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার বানাইল ইউনিয়নের দেওরা গ্রামে। মেহেদী হাসান পরিবারের বড় ছেলে স্বপ্ন ছিল বিদেশে গিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারের অভাব-অনটন দূর করবেন। তাইতো পাসপোর্ট করার জন্য কাগজপত্র রেডি করছিলেন। কিন্তু ভাগ্যে আর সহায় হলো না। আর সেই স্বপ্নপূরণ হলো না। তার আগেই ভয়াবহ আগুনে স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেল মেহেদী হাসানের। এমন মৃত্যু যেন কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছে না মেহেদীর পরিবার। এখনো শোকের মাতম কাটেনি পরিবারের। উপার্জনকারী সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা পরিবারের সদস্যরা। পরিবারের মাঝে নেই ঈদের আনন্দ।
জানা যায়, মেহেদী রাজধানী ঢাকার বেইলি রোডের বহুতল ভবনের ২য় তলায় একটি ফাস্টফুডের দোকানে চাকরি করতেন। গত (২৯ ফেব্রুয়ারি) এই ভবনে আগুনে নিহত ৪৬ জনের মধ্যে ছিলেন মেহেদী হাসান। গত (১ মার্চ) মেহেদীর মরদেহ উপজেলার বানাইল ইউনিয়নের দেওরা গ্রামে নিয়ে আসা হয়। মেহেদী দীর্ঘ দিন ধরে বেইলি রোডে অগ্নিকন্ডের ওই ভবনেই দ্বিতীয় তলায় একটি ফাস্টফুডের দোকানে চাকরি করতেন। মেহেদীর ছোট ভাই ইসরাফিল একই জায়গায় কাজ করলেও অগ্নিকান্ডের সময় কাজে ভবনের অন্য একটি তলায় গিয়েছিলেন। যে কারণে মেহেদীর ছোট ভাই ইসরাফিল প্রাণে বেঁচে যান।
পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, মেহেদী হাসান বিগত ২০১২ মির্জাপুর কোড়ালিয়া পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। বিগত ২০১৪ সালে দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি আরফান খান মেমোরিয়ার ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। অভাব অনটনের সংসারের হাল ধরতে ঢাকাতে চাকনি নেন। চাকরি নেয়ার পর সংসার ভালোই চলছিল। বাবার মার মুখে হাসির ঝলক উঠে ছিল। কিন্তু বেইলি রোডে আগুনে পুড়ে নিহত হন মেহেদী। সে মারা যাওয়াতে তাদের সংসার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সংসারে উপার্জনকারী ছোট ভাই ছাড়া আর কেউ রইলো না। কি দিয়ে তাদের সংসার চলবে এ চিন্তায় তারা এখন দিন পাড় করছেন। মেহেদীর বাড়িতে নেই ঈদের আনন্দ।
এদিকে স্থানীয় এমপি খান আহমেদ শুভ মেহেদীর পরিবারকে নগদ অর্থ প্রদান করেছেন। তার ছোট ভাই ইসরাফিলকে চাকরি দেয়ার আশ্বাস দেন। মেহেদীর ছোট ভাই ইসরাফিল মিয়া বলেন, আমরা দুইভাই একই জায়গায় কাজ করতাম। অগ্নিকান্ডের আগেই আমি একটি কাজে ভবনের অন্য আরেকটি ফ্লোরে ছিলাম। পরে আমি ভবন থেকে লাফিয়ে প্রাণে বেঁচে যাই। গত বছর আমরা দুই ভাই বাবা-মার সাথে ঈদ করেছি। আর কোনদিন ভাইয়ের সাথে ঈদ করা হবে না আমাদের। দুই ভাই মিলে সংসার হাল ধরতে চেয়েছিলাম আর তা কোন দিন পূরণ হবে না। জানিনা এখন এ স্বপ্ন আমি পূরণ করতে পারবো কিনা। সরকারের কাছে দাবি জানাই আমাদের সহযোগিতা করা হোক।
মেহেদীর বাবা আয়নাল হক বলেন, অভাব অনটনের সংসার চালাতেই দুই ভাই কাজ করতেন ঢাকাতে। বড় ছেলে মেহেদীর বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন ছিল। পাসপোর্ট করার জন্য কাগজপত্র রেডি করতে ছিল। মেহেদী স্বপ্ন দেখতো, বিদেশে গিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারের অভাব অনটন দূর করবে। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। তার স্বপ্নপূরণ হলো না। আমরাও বয়স হয়ে গেছে কিছু করতে পারি না। আমি ঋণ করেছি বড় ছেলে ঋণের টাকা প্রতিমাসে দিতো। এ টাকা এখন কে দিবে। গত বছর মেহেদী আমাদের সাথে ঈদ করেছে। আর কোন দিন আমার ছেলে আমাদের সাথে ঈদ করতে পারবে না। এ সংসার এখন কিভাবে চলবে। কে দেখবে এ সংসার। মাথায় আর কাজ করে না। কদিন পরে ঈদ আমাদের মাঝে সে আনন্দ নেই। ছেলের মা সব সময় কান্না করে। কান্না করতে করতে ছেলের মাও অসুস্থ হয়ে গেছে। সরকারের কাছে দাবি জানাই আমাদের যেন সহযোগিতা করেন।
মেহেদীর মা কল্পনা বেগম বলেন, মেহেদী বড় ছেলে ছিল। আমাদের সংসারে হাল ধরেছে সে পরিবারের সব খরচ দিতো। এখন এ সংসার কে দেখবে। গত বছর এক সাথে ঈদ করেছি। আমাদের জন্য গত বছর কাপড় ও বাজার করে নিয়ে আসছিল। এবার আর কেউ আসবে না। এ বলে মেহেদীর মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর মেহেদীর জন্য দোয়া করছেন।
মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ নুরুল আলম বলেন, মেহেদীর পরিবারকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছে। আমরা আরও সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।