
বিশেষ রিপোর্টার ॥
তৃণমুলে জমে উঠেছে ঈদ ও বৈশাখ কেন্দ্রিক রাজনীতি! আলোচিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এবারই প্রথম আসা ঈদ ও বৈশাখ উদযাপনে মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী নেতারা ছুটে এসেছেন নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায়। বসে নেই বিএনপিসহ অন্যান্য দলের নেতারাও। তারাও নির্বাচনী এলাকায় এসেছেন ঈদ ও বৈশাখ পালন করতে। তবে এবার নিজের বা দলের জন্য গণসংযোগ নয়, সবারই টার্গেট আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন।
উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দিয়ে উন্মুক্ত রাখায় এবার সবাই মাঠে নেমেছেন নিজেদের পছন্দের নেতাদের ‘উপজেলা চেয়ারম্যান’, ভাইস চেয়ারম্যান বানিয়ে নিজেদের একক কর্তৃত্ব নিশ্চিত করতে। নির্বাচনী এলাকায় ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি সাধ্যমতো মানুষের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে আড়ালে-গোপনে ভোট চাইতে বাদ রাখছেন না। এতে তৃণমূলে সময়ের ব্যবধানে দলীয় বিভক্তি ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। সব মিলিয়ে এবারের ঈদ ও বৈশাখকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থীকে সমর্থন না দেওয়া এবং কাউকে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক তৃণমূল ও কেন্দ্রীয় নেতা তাদের পছন্দের প্রার্থীর পেছনে ঝুঁকছেন। উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে ঈদ ও বৈশাখ কেন্দ্রিক রাজনীতির সুযোগ নিতে তৃণমূলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, বর্তমান মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য, পরাজিত সংসদ সদস্য প্রার্থী এবং (৭ জানুয়ারির) নির্বাচনে জয়ী ‘স্বতন্ত্র’ আইনপ্রণেতাদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। কেন্দ্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তৃণমূল নেতারা ইতোমধ্যেই নির্বাচনে জয়লাভের জন্য মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা উপজেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে মাঠে নেমেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে ত্রিমুখী অবস্থানের কারণে প্রতিটি উপজেলা পরিষদে আওয়ামী লীগের প্রার্থিতার ছড়াছড়ি। স্থানীয় নেতাকর্মী, সমর্থকরা ইতোমধ্যেই নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী মাঠ গরম করছেন। এই সুযোগটি কাজে লাগাতে চাইছে নির্বাচনী বর্জনকারী দল বিএনপি-জামায়াতসহ তাদের মিত্ররা। প্রকাশ্য না হলেও গোপনে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে ক্ষমতাসীন দলের বিভক্তির সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বিজয় নিশ্চিত করতে চাইছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গ্রেপ্তারের কোনো ভয় না থাকায় বিএনপিসহ তাদের মিত্র রাজনৈতিক দলের নেতারাও এবারের ঈদ উদযাপনে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় এসেছেন। ঈদকেন্দ্রিক রাজনীতিতে অংশ নিয়ে তাঁরাও নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে গোপনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সংসদ নির্বাচনের পর প্রথম ঈদ এটি। তাই নির্বাচনী এলাকায় ছুটছেন মন্ত্রী-এমপিরা ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পদধারী নেতারা। গুরুত্ব দিচ্ছেন উপজেলা নির্বাচনকে। দলের হাইকমান্ডের নিষেধ থাকলেও নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে নানাভাবে সামনে রাখার চেষ্টা করছেন তাঁরা। সব মিলিয়ে এবারের ঈদকে তৃণমূলে অন্যরকম আমেজের সৃষ্টি করেছে। নিজেদের কর্তৃত্ব কিছুইতে খর্ব করতে নারাজ মন্ত্রী-এমপিরা। এবারের তার সঙ্গে যোগ হয়েছে দ্বাদশ নির্বাচনে বিজয়ী রেকর্ডসংখ্যক স্বতন্ত্র আইনপ্রণেতারা। দলীয় ও স্বতন্ত্র এমপিরাও নিজ নির্বাচনী এলাকায় তাঁদের পছন্দের কেউ উপজেলা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসুক, সেই চেষ্টায় ঈদ ও বৈশাখে ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এদিকে, নির্বাচনী এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে পছন্দের লোককে প্রার্থী করার বিষয়টি নিয়ে দলীয় ও স্বতন্ত্র এমপিদের সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। উপজেলা নির্বাচন ঘিরে এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। বারবার কেন্দ্র থেকে মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের ‘মাইম্যান’ বানানোর প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হলেও কেউই তা মানছেন না। বরং দলীয় ও স্বতন্ত্র এমপিরা নিজ নিজ এলাকায় নিজেদের পছন্দের নেতাদের উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে। ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দলের সাংগঠনিক যে বিশাল ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, উপজেলা নির্বাচন যেন ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিসহ তৃণমূল নেতাদের হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তারের ঘটনায় উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে। এজন্য প্রার্থিতা ঘোষণার চেষ্টায় নিষেধাজ্ঞা এবং কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হলেও বিরূপ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, পদত্যাগ করে এমপি নির্বাচন করে পরাজিত সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানরা আবারও নিজের ছেড়ে দেওয়া আসনটি ফিরে পেতে প্রার্থী হয়ে মাঠে নেমেছে। প্রতিটি উপজেলায় ক্ষমতাসীন দলের একাধিক প্রার্থিতার কারণে যে বিভেদ-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে, সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থিতার ব্যানারে অংশ নেওয়া বিএনপি-জামায়াতের নেতারা বিজয়ী হওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ কারণে উন্মুক্ত নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য নতুন করে প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। অনেক উপজেলাতে এমপিদের পুত্র-ভাই-স্ত্রী বা নিকটাত্মীয়দের প্রার্থী করে বিভক্তির মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ উপজেলা নির্বাচন আয়োজনে মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের হস্তক্ষেপ ঠেকানোর উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কেউ হস্তক্ষেপ করলে তা যেমন সফল করতে না পারে। আর প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার পর কেউ দলীয় নির্দেশ অমান্য করলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।