শিশুদের মোবাইল আসক্তিতে শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বিরূপ প্রভাবের আশংকা

টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল স্পেশাল মধুপুর লিড নিউজ শিক্ষা স্বাস্থ্য

হাবিবুর রহমান, মধুপুর ॥
গেমস টিকটক ফেসবুসহ নানা বিষয়ে ব্যবহারে শিশুদের মোবাইল আসক্তি ব্যাপক হারে বাড়ছে। কোমলমতি শিশুদের শিক্ষা স্বাস্থ্য বিনোদন ঘুম খাওয়া দাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কাজে মারাত্বক ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে শারীরিক মানসিক ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি। শিশুদের মোবাইল আসক্তিতে উদ্ধিগ্ন হচ্ছে অভিভাবকরা। শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বিরূপ প্রভাবের আশংকা বিশেষজ্ঞদের। ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের অধিকাংশ খাওয়া দাওয়া করে মোবাইল দেখে দেখে। মোবাইল খাবারের সামনে না দিলে খেতে চায় না। এভাবে শিশুদের মোবাইল আসক্তি বাড়তে থাকলে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন।
অনলাইন নেট দুনিয়ার নেগেটিভ দিকগুলোর দিকে ধাবিত হলে তাদের জীবনে নেমে আসতে পারে চরম সর্বনাশের বিপর্যয়। এ বিষয়ে অভিভাবক শিক্ষক সমাজ সচেতন ব্যক্তিদের আরো সচতেন হওয়া জরুরি বরে মনে করছেন সংশিষ্টরা।
টাঙ্গাইলের মধুপুর ধনবাড়ি ঘাটাইল গোপালপুরসহ আশপাশের উপজেলার বিভিন্ন পাড়া গ্রাম মহল্লা ও
শহরের অলিগলি দেখা যায়,স্কুল পড়ুয়া শিশুরা কয়েক জন একত্রে বসে বসে মোবাইলে গেমস খেলছে। কেউ কেউ আবার একা একা বসে দেখছে। কোথাও আবার দল বেঁধে চুপচাপ বসে বসে মোবাইল দেখাদেখি করছে। এমনটা চিত্র যেন গ্রাম পর্যায় থেকে শুরু শহরের বাসা বাড়ি পর্যন্ত। বিভিন্ন চায়ের দোকানে কাজ করা শিশুদের হাতেও দেখা গেছে এন্ড্রোয়েট মোবাইল। বাদ পড়ছে না দিন মজুর রিকসা রাখালসহ পথের টোকাই পর্যন্ত। এ যেন এক ভয়ানক ব্যাধিতে রৃপ নিচ্ছে। মোবাইল যেন শিশু কিশোরদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার মত এক বিনোদন খোরাক। স্কুল কলেজের ফাঁকে ফাঁকে আর সকারে ঘুম থেকে উঠার পরই যেন এক অমৃত কোন খাবারের মত লোফে নেয়া খোরাক। নিমগ্ন চিত্তে তারা চুপচাপ দেখে সময় কেয়া পাড়ি দিচ্ছে। এ অবস্থায় অনেক পরিবারে বাবা মা অভিভাবকরা তাদের ছেলে মেয়েদের মোবাইল আসক্তি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
১০০ শয্যা বিশিষ্ট মধুপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. সাইদুর রহমান বলেন, মোবাইল ফোন মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বিরূপ প্রভাব পড়ে। শারীরিক সমস্যা ঘুমের অসুবিধা, পরিপূর্ণ ঘুম না হওয়া, পিঠ, কোমরে, মাথা ব্যথা, চোখ ব্যথা বা চোখের জ্যোতি কমে যাওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া, পুষ্টিহীনতা দেখা দেয়। উদ্বিগ্নতা, অসততা, নিজেকে দোষী বোধ করা, অতি চঞ্চলতা ও হিংসাত্মক আচরণ করা। এসব শিশুরাসারাক্ষণ একা থাকতে ভালোবাসে। ফলে বাইরে যাওয়া, অন্যদের সঙ্গে মেশা, সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা ও সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলার প্রবণতাও কমে যাওয়ার মতো মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তার মতে, মোবাইলে আসক্ত হওয়ার ফলে শিশুদের চোখে রেটিনায় দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ ক্ষতির পরিমাণ এখন হয়তো বোঝা যাবে না, কিন্তু বাচ্চার বয়স যখন ১৫ বছর বয়স হবে তখন তার চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। মোবাইল ফোন আসক্তির কারণে অনেক শিশুর চোখ টেরা (বাঁকা) হয়ে যেতে পারে। এখন আমাদের দেশে বাঁকা চোখের শিশু অনেক বেশি, এর অন্যতম প্রধান কারণ মোবাইল আসক্তি। ১৫ বছর পর্যন্ত শিশুদের মোবাইলের কাছেই যাওয়া উচিত নয়। গ্রোয়িং ব্রেনের ওপর মোবাইলের ইলেকট্রিক ম্যাগনেটিক ওয়েব মারাত্মক ক্ষতি করে। এতে শিশুদের কথা না বলা এমনকি স্পিচ ডিলে (দেরিতে কথা বলা) সমস্যা, শিশুদের অন্যান্যদের সঙ্গে কমিউনিকেশনের সমস্যা দেখা দেয়। মানসিক সমস্যা এমনকি অনেক সময় শিশুরা অটিস্টিকও হয়ে যায়। মোবাইলের রেডিয়েশন থেকে শিশুদের অনেক ক্ষতি হতে পারে। এমনটিই জানালেন এই শিশু বিশেষজ্ঞ। তার মতে, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে এই বিষয়ে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরী।
অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, করোনা মহামারির সময় থেকে শিশুদের মোবাইল ব্যবহার ও আসক্তি বেড়েছে। শিশুদের ভবিষ্যত জীবন সুন্দর করার স্বার্থে অনিচ্ছা সত্তে¦ও এ সময় অনলাইন ক্লাসে অংশ গ্রণের জন্য অভিভাবকরা বাধ্য হন তাদের সন্তানদের হাতে এনড্রয়েড মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবসহ নানা ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস তুলে দিতে। অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি কৌতূহল থেকে শিশুরা নানা ধরনের গেমস খেলতে শুরু করে। আসক্ত শিশু-কিশোররা নাওয়া-খাওয়া ভুলে ধীরে ধীরে মত্ত হয়ে পড়ে গেমসে। এসব ডিভাইসের নেশায় ভাসতে থাকা শিশুরা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে দেখা দিচ্ছে এর নেতিবাচক প্রভাব। এমনটাই জানালেন বেশির ভাগ অভিবাবকরা।
মোবাইল বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা যায়, উঠতি বয়সীদের মধ্যে বেড়েছে মোবাইল ফোনে নানা সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, টিকটক, পাবজি, ফ্রি-ফায়ার, ইউটিউব, কার্টুনসহ হরেক রকম ভিডিও গেমসে আসক্তি। যার রেশ না কমে উল্টো বাড়তে থাকে। ফলে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে মাথাধরা, মাথা ও হাত-পা ব্যথা, খাবারে অরুচি, ঘুম ও দৃষ্টিশক্তির সমস্যা, ঘুমের ঘোরে নানাবিধ প্রলাপ বকা, আগ্রাসি আচরণ এবং তার সঙ্গে এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। কেউ কেউ নেশাসহ কিশোর অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। যার প্রভাবে মানসিকভাবে বিষন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং তাদের অল্পতেই রেগে যাওয়ার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এসব তথ্য অভিভাবক ও মোবাইল অভিজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশার প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্পের সুপারভাইজার আলকামা শিকদার বলেন, পড়া লেখার চেয়ে মোবাইলের প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি। বই খাতার চেয়ে মোবাইলের কার্টুন, গেমসের প্রতি আকৃষ্ট যার কারণে খাবরটাও খাওয়াতে হয় মোবাইল দেখিয়ে। ফলে তাদের মাথায় মোবাইলটা জায়গা করে নিচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
আউশনারা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শহিদুল ইসলাম বলেন, শিশুরা কয়েক জন একত্রে হয়ে মোবাইল দেখে ঘন্টার পর ঘন্টা। জুয়া ক্যাসিনোসহ নানা অপব্যহারের ফলে শিশু যুবসমাজ ধ্বংস হচ্ছে।
মধুপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জুবায়ের হোসেন বলেন, শিশুর প্রথম শিক্ষালয় হচ্ছে তার পরিবার। সে জন্য মোবাইল আসক্তি রোধে প্রথমে বাবা মাকে সময় দিতে হবে। পরিবার থেকেই শিশুরা মোবাইলর প্রতি আসক্তি হয়। অনেক শিশুরাই ঘুম থেকে উঠে মোবাইল দেখে থাকে। এ জন্য পরিবার ও স্কুল কলেজের শিক্ষক জনপ্রতিনিধি সুশীল সমাজসহ সবাইকে আরো সচেতন হতে হবে বলে তিনি মনে করনে ।
শিশুদের এমন মোবাইল আসক্তির লাগাম এখনই টেনে ধরতে না পারলে চরম সর্বনাশ নেমে আসতে পারে। পরিবার অভিভাবক শিক্ষক প্রশাসনসহ সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। জনসচেতনতা বাড়িয়ে শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে হলে এমন আসক্তি থেকে ফেরাতে হবে। সময় দিতে হবে,খোঁজ খবর নিতে হবে শিশুদের ও নজর বাড়াতে হবে পরিবারের সদস্যদের। এমনটাই দাবি সংশ্লিষ্টদের।

 

২৮৪ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *