বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মানে অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন শতশত শ্রমিক

কালিহাতী টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল স্পেশাল ভূঞাপুর লিড নিউজ

হাসান সিকদার ॥
নাম আবু হানিফ। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলা সদরে। চার সদস্যের সংসার তার পরিবারে। একটি তাঁত পল্লীতে কাজ করতে। করোনার সময় সে তাঁত পল্লী বন্ধ হয়ে যায়। এতে বেশ কিছুদিন বাড়িতে বসা ছিলেন। তারপর বিভিন্ন জনের কাছে ঘুরে খোঁজখবর নিয়ে বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে নির্মাণ শ্রমিকের চাকরি নেন। বঙ্গবন্ধু সেতু রেল ট্যাগে শুরু থেকেই কাজ করে চলেছেন। মধ্য বয়সি আবু হানিফ বলেন, আমি বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে কাজ করে আনন্দ পাচ্ছি। এতো বড় কাজের আমি একজন শ্রমিক হয়ে কাজ করছি এটা আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। এখানে আমার মতো আরও বহু শ্রমিক কাজ করছে। এ কাজ করার পর থেকেই আমার সংসার ভাল চলছে। এখানে রেলের ক্যাবল, ক্লিপ লাগানোর কাজ করি। বর্তমানে এতো রৌদ উপেক্ষা করে খুব কষ্ট নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। তারপরও তো করতে হবে, আমার উপর নির্ভর করে সংসার। যে রৌদ আর দ্রব্যমূল্যের যে দাম সে অনুযায়ী আমাদের পোষায় না। এখানে কাজের জন্য মাসে ১৩-১৪ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছি। আমাদের বেতন ১৮-২০ হাজার হলে পরিবার নিয়ে ভালো ভাবে চলতে পারবো। কষ্ট হলেও আনন্দ পাই, কারন দেশের এতো বড় একটা রেল সেতু হচ্ছে। আমার পরিবার ও আমি গর্ব করে বলতে পারবো এখানে কাজ করেছি। দেশের জন্য কাজ করছি ভালো লাগে।
বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মান কাজে শুধু আবু হানিফ নয়, তার মতো বিভিন্ন পদে কাজে নিয়োজিত রয়েছেন শতশত শ্রমিক। সরেজমিনে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর নির্মান কাজ চলছে। শতশত শ্রমিকরা সেখানে কাজ করছে। কেউ পাথর টানছেন, আবার কেউ রেল সেতুর কাজ করছেন। এভাবেই বিভিন্ন শ্রমিকরা প্রতিনিয়তই কাজ করে যাচ্ছেন। আরেক শ্রমিক শহিদুল ইসলাম বলেন, এর আগে অন্য জায়গায় কাজ করতাম। যমুনা নদীতে রেল সেতুর কাজ শুরু হয় তখন এখানে চাকরি নেই। এটাতে বেতন ভালো দেখে এখানেই রয়েছি। আমি ১৮-২০ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছি। পরিবার নিয়ে বর্তমানে অনেক সুখে আছি। এখন অনেক রৌদ্রের মধ্যে কাজ করতে হয়, অনেক কষ্ট হয়। তারপরও ভালো লাগে, কারণ ছেলে মেয়ে গর্ব করে বলতে পারবে বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে আমার বাবা কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, এক ছেলে ও এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে আমার সংসার। মেয়ে এমএ পাশ করেছে। ছেলে অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। তাদের একটা চাকরি হলে আমার স্বপ্ন পূরণ হবে এই রৌদ্রের মধ্যে শরীর পুড়ে কাজ করতে হবে না। এখানে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর আমার বাড়ি। সেখান থেকে এসে ডিউটি করি। পরিবারের সাথেও সময় দিতে পারি। অনেক ভালো লাগে এখানে কাজ করে। আমি পদ্মা সেতুতে কাজ করেছি, বরিশালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করেছি। বর্তমানে এখানে কাজ করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে এতো বড় রেল সেতু নির্মাণ হচ্ছে। আমরাও কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর কাজ শেষ হওয়ার পর আবার কোথায় যাবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই কাজ শেষ হওয়ার পর কি করবো জানি না, আল¬াহ কপালে যেখানে রেখেছে সেখানেই হবে।
অপর শ্রমিক আবু রাজ্জাক বলেন, আমি ২৪ বছর টেক্সটাইলে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেছি। ছায়ার মধ্যে সব সময় থাকতাম। ওই কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে কাজ করছি। এখন প্রচন্ড রৌদ্রে পুড়ে কাজ করতে হচ্ছে। কাজ করতে খুব কষ্ট হয়। তবুও কি করবো বসে থাকলে তো পেট চলবে না। বউ-পোলাপান না খেয়ে মারা যাবে। প্রতিদিন ৮ ঘন্টা ডিউটি করতে হয়। যা বেতন পাই ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করিয়ে সংসার কোন রকম চলে। আমাদের বেতন যদি বাড়ানো হয় তাহলে পরিবার নিয়ে ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে ভালোভাবে চলতে পারবো। জানা যায়, যমুনা নদীর ওপর নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতুর শেষ ৪৯ তম স্প্যানটি বসেছে গত শুক্রবার (২০ এপ্রিল)। এর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হলো দেশের দীর্ঘতম রেলসেতুর পুরো অবকাঠামো। রেলসেতুতে যুক্ত হলো যমুনা নদীর দুই পার। এখন রেলপথ বসানোসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ হলে এ সেতু দিয়ে চলবে ট্রেন। উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রেলযাত্রীদের এখন সেটিরই অপেক্ষা।

সূত্র জানায়, গত শুক্রবার (২০ এপ্রিল) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতুর পশ্চিম অংশে ৫ থেকে ৬ নম্বর পিলারে ৪৯ তম স্প্যান বসানো হয়। এর মধ্য দিয়ে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুর সব স্প্যান বসল। আর এ পর্যন্ত সেতুর ৮৪ শতাংশ কাজ শেষ হলো। অবশিষ্ট কাজ শেষ হলে আগামী আগস্ট নাগাদ পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল ও ডিসেম্বরের শেষ দিকে সেতু দিয়ে নিয়মিত ট্রেন চলাচল শুরু হবে। এতে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু দিয়ে চলাচলকারী ট্রেনগুলোর ন্যুনতম ৩০ মিনিট (ক্ষেত্রবিশেষে দেড় ঘন্টা পর্যন্ত) সময় সাশ্রয় হবে। সেই সঙ্গে দিনে কমপক্ষে ৮৮টি ট্রেন দ্রুতগতিতে সেতু পার হতে পারবে। বঙ্গবন্ধু রেলসেতুতে সর্বশেষ স্প্যান বসানোর খবরে উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের মধ্যে বইছে উচ্ছ্বাসের হাওয়া। দেশি-বিদেশি ৫ সহস্রাধিক প্রকৌশলী-শ্রমিক দিন-রাত সুদক্ষভাবে সেতুটির বাস্তবায়নের কাজ করছে। দেশের বৃহৎ রেল সেতু নির্মাণের সাক্ষী হতে পেরে উচ্ছ্বসিত তারাও।
সূত্রমতে, বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে বর্তমানে ঘন্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে প্রতিদিন ৩৯টি ট্রেন পারাপার হয়। এতে সময় অপচয়ের পাশাপাশি শিডিউল বিপর্যয় দেখা দেয়। তবে নতুন রেল সেতুর কাজ শেষ হওয়ার পর ৮৮টি ট্রেন চলাচল করবে ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে। পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে রেলপথে পণ্য পরিবহণের সুবিধা বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ রুটে সহজে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণসহ সার্ক, বিমসটেক, সাসেক ও অন্যান্য আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক রেলওয়ে রুট এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথ নেটওয়ার্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এ সেতু। টাঙ্গাইল অংশের ভূঞাপুর উপজেলা ও সিরাজগঞ্জের অংশের যমুনা নদীর ওপর এবং বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উত্তরে পৃথক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয় বিগত ২০২০ সালে। ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন এ সেতুর দেশীয় অর্থায়ন ২৭.৬০ শতাংশ। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ দিয়েছে ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা, যা প্রকল্পের ৭২.৪০ শতাংশ। মূল সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জাপানি কোম্পানি ওটিজি ও আইএইচআই জয়েন্টভেঞ্চার। সেতুর ৮৪ শতাংশের পাশাপাশি দু’পাশের ১৩ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ শেষ হয়েছে ৫০ শতাংশ। সেতুর পূর্ব স্টেশন ও পশ্চিম স্টেশনের কাজ শেষ হয়েছে ৫০ শতাংশ।।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান বলেন, মূল সেতুর অবকাঠামোর কাজ শেষ। ফলে দৃশ্যমান হয়েছে রেলসেতুটি। অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ করে টেস্টিং, কমিশনিং করে ডিসেম্বরের (২০২৪) শেষে বা জানুয়ারির (২০২৫) প্রথম সপ্তাহের দিকে সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হবে।
অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শেখ নাইমুল হক বলেন, বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর ভৌত কাজ শেষ হয়েছে ৮২ শতাংশ। আর্থিক কাজের অগ্রগতি ৬০ দশমিক ৬১ শতাংশ। প্রকল্পের কাজ ডিসেম্বরে শেষ হলেও যাত্রী চলাচল শুরু হতে জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে বলে ধারণা এ প্রকল্প কর্মকর্তার। তিনি আরও বলেন, ফিক্সিং ও ট্র্যাক বসানো হচ্ছে এখন। একইসঙ্গে টেলিকমিউনিকেশনের কাজও শেষ করা হচ্ছে।

 

 

২৯১ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *