
সাদ্দাম ইমন ॥
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল, কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলায় নির্বাচন মঙ্গলবার (২১ মে) ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। রাত পোহালেই নির্বাচন। এরই মধ্যে স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সুষ্ঠুু নির্বাচনের লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। এরই মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা শেষ হয়েছে। তিন উপজেলায় নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা নানা প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভোটারদের মন জয় করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটেছেন। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে উপজেলা শহর, গ্রামের হাট-বাজার, অলিগলিসহ বিভিন্ন এলাকা ও পথ-প্রান্তর। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা গণসংযোগের পাশাপাশি উঠান বৈঠক ও পথসভা করেছেন সাধ্যমতো। এক কথায় জমজমাট হয়ে উঠেছে এই তিন উপজেলা পরিষদের নির্বাচনী লড়াই। প্রচারণাকালে তিনটি উপজেলায়ই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা একে-অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন। এক প্রার্থী অপর প্রতিদ্বন্দ্বীর চৌদ্দগোষ্ঠীর আমলনামা তুলে ধরে ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করেছেন। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘণের দায়ে কয়েক প্রার্থীকে জরিমানাও গুণতে হয়েছে।
১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত ঘাটাইল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি লোকমান হোসেন (মোটরসাইকেল) ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মুহাম্মদ আরিফ হোসেন (আনারস) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। লোকমান হোসেনের পক্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দলবদ্ধ হয়ে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। অপরদিকে, আরিফ হোসেনের পক্ষে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সমর্থন রয়েছে। ফলে এ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।
ভাইস চেয়ারম্যান পদে ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সদ্য সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কাজী আরজু (তালা), আতিকুর রহমান (চশমা), বিএনপি পরিবার থেকে আব্দুস ছালাম খান আওয়াল (টিউবওয়েল) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে সদ্য সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহীনা সুলতানা শিল্পী (সেলাই মেশিন), বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত উপজেলা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক তাসলিমা জেসমিন পাপিয়া (প্রজাপতি) এবং সাবেক ইউপি সদস্য নাজমুন নাহার নাজমা (কলসি) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ঘাটাইল উপজেলায় মোট ভোটার তিন লাখ ৬০ হাজার ৭৮১ জন। এর মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৮১ হাজার ২৬৫ জন এবং মহিলা এক লাখ ৭৯ হাজার ৫১৪ জন। ১২০টি কেন্দ্রের ৮৭১টি কক্ষে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
কালিহাতী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মূলত: আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সিদ্দিকী পরিবার আবির্ভুত হয়েছে। জম্পেস লড়াই চলছে প্রার্থীদের মাঝে। টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে আলোচিত সিদ্দিকী পরিবারের ভাইদের ছোটজন করটিয়া সা’দত কলেজের সাবেক ভিপি শামীম আল মনসুর সিদ্দিকী ওরফে আজাদ সিদ্দিকী (আনারস) এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত একক প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মোল্লার (মোটরসাইকেল) নির্বাচনী লড়াই ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। এ উপজেলার বাংড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হাসমত আলী নেতা (দোয়াতকলম) চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী থাকলেও তেমন প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।
আজাদ সিদ্দিকীর (আনারস) পক্ষে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম বেশকয়েকটি এলাকায় নির্বাচনী সভায় অংশ নিয়ে ভাইয়ের জন্য ভোট চেয়েছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সাবেক সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী বড় ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দিকী স্থানীয় সংসদ সদস্য হওয়ার কারণে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ না নিলেও ছোট ভাই আজাদ সিদ্দিকীর প্রতি সমর্থন রয়েছে বলে তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন।
উপজেলার রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, সিদ্দিকী পরিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো কালিহাতী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিজয়ী হয়ে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান আরও সুসংহত করতে চাইছে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সিদ্দিকী পরিবারের আধিপত্য রোধ করতে দলীয় সমর্থিত প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে।
কালিহাতীর রাজনীতিতে সিদ্দিকী পরিবারের বিশাল প্রভাব রয়েছে। লতিফ সিদ্দিকী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে তাঁর পাশে ছিলেন ছোট ভাই কাদের সিদ্দিকী ও আজাদ সিদ্দিকী। এবার আজাদ সিদ্দিকী তাঁর বড় দুই ভাইয়ের সমর্থন নিয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। লতিফ সিদ্দিকী সরাসরি নির্বাচনের মাঠে না নামলেও নেপথ্যে থেকে ভাইয়ের জন্য কাজ করছেন। কাদের সিদ্দিকী একাধিক দিন কালিহাতীর বিভিন্ন এলাকায় ছোট ভাইয়ের পক্ষে গণসংযোগ করেছেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মোল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গণসংযোগ করছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পক্ষের নেতারা তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। সাবেক সংসদ সদস্য হাসান ইমাম খান সোহেল হাজারি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মোজহারুল ইসলাম তালুকদার, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনসার আলী, জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক আবু নাসেরসহ বিভিন্নস্তরের নেতা-কর্মীরা আনোয়ার মোল্লাকে বিজয়ী করতে কাজ করছেন।
কালিহাতী উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে পাঁচজন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হচ্ছেন- উপজেলা পরিষদের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান (টিউবওয়েল), আব্দুল্যাহ সরকার (চশমা), আব্দুল বারেক (উড়োজাহাজ), মাহমুদুল হাসান দীপুল (তালা) ও জমীর উদ্দিন আমেরী (বই)। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে উপজেলা পরিষদের বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রীনা পারভীন (প্রজাপতি) ও উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ফাতেমা খাতুন বৃষ্টি (ফুটবল)।
১৩টি ইউনিয়ন ও দুইটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত কালিহাতী উপজেলায় ২০১৯ সালের গণনা অনুযায়ী মোট ভোটার তিন লাখ ১২ হাজার ১১২ জন। এরমধ্যে পুরুষ এক লাখ ৫৫ হাজার ৪০৫ জন এবং মহিলা এক লাখ ৫৬ হাজার ৭০৭ জন।
ভূঞাপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও গত (৮ মে) থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ভূঞাপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম তালুকদার বিদ্যুৎ (মোটরসাইকেল) ও উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক তাহেরুল ইসলাম তোতা (আনারস) নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। অপর তিন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ভোটারদের দ্বারে দ্বারে নানা কৌশলে ভোট প্রার্থণা করেছেন। তারা হচ্ছেন- বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা মহিলা লীগ নেত্রী নার্গিস বেগম (দোয়াতকলম), আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ চৌধুরী (হেলিকপ্টার) ও উপজেলা বিএনপির বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান তালুকদার বাবলু (ঘোড়া)।
ভূঞাপুর উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, তৃণমূলের আওয়ামী লীগ নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধারা নার্গিস বেগমকে সমর্থন দেওয়ায় তিনি প্রায় ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন। তারপরও তাঁর প্রচারণা থেমে নেই। আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ চৌধুরী (হেলিকপ্টার) প্রতীক নিয়ে পৌরসভাসহ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেড়িয়েছেন। উপজেলা বিএনপির বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান তালুকদার বাবলু (ঘোড়া) প্রতীকে নির্বাচন করছেন। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরও জনপ্রিয়তার কারণে ভোটারদের কাছে তিনি প্রিয়পাত্র।
ভূঞাপুর উপজেলায় পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদে খোরশেদ আলম (টিয়াপাখি), ওয়াজেদ আলী খান (মাইক), আরিফুল হক (টিউবওয়েল) ও মনিরুল ইসলাম (তালা)। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে আলিফ নুর (প্রজাপতি), মঞ্জুয়ারা বেগম (পদ্মফুল), সাদিয়া আফরিন খানম (ফুটবল) ও হোসনে আরা বেবী (কলসী) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
৬টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত ভূঞাপুর উপজেলায় মোট ভোটার এক লাখ ৬৬ হাজার ৮৬৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৮৪ হাজার ৬৯১ জন ও মহিলা ভোটার ৮২ হাজার ১৭৮ জন।