কাজল আর্য ॥
টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী সিদ্দিকী পরিবারের পৈত্রিক ভিটা কালিহাতী উপজেলার ছাতিহাটী গ্রামে। দীর্ঘদিনের কোণঠাসা পরিস্থিতি কাটিয়ে বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এবারের উপজেলা নির্বাচনেও কালিহাতীতে সিদ্দিকী পরিবার তাদের আধিপত্য ধরে রেখেছে। পরিবারের বড় ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দিকী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদারকে হারিয়ে স্বতন্ত্র এমপি এবং ছোটভাই শামীম আল মনসুর আজাদ সিদ্দিকী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মোল্লাকে হারিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তবে কালিহাতীতে দুটি নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের হারের ফলে সাময়িকভাকে দল বড় ধাক্কা খেয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নেতারা। পরাজয়ের নেপথ্যে সিদ্দিকীদের জনপ্রিয়তা এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলই মূল কারন।
নব-নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা আজাদ সিদ্দিকী বঙ্গের আলীগড় খ্যাত সরকারি সা’দত কলেজ ছাত্র-সংসদের সাবেক এজিএস এবং ভিপি। তিনি (আনারস) প্রতিকে ৫২ হাজার ৯১০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দি প্রার্থী কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মোল্লা (মোটরসাইকেল) ৪৫ হাজার ৬৮৫ ভোট পেয়ে পরাজিত হয়েছেন। তাকে পুরো উপজেলা আওয়ামী লীগ সমর্থন দেয়। আনোয়ার মোল্লা দুঃসময়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার ছোটভাই নূরে এ আলম সিদ্দিকী উত্তরবঙ্গের প্রবেশপথ এলেঙ্গা পৌরসভার বর্তমান মেয়র।
উপজেলা নির্বাচনে আজাদ সিদ্দিকীর (আনারস) পক্ষে তাঁর বড়ভাই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম বেশকয়েকটি স্থানে নির্বাচনী সভায় অংশ নিয়ে ভাইয়ের জন্য ভোট চেয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী বড়ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দিকী স্থানীয় সংসদ সদস্য হওয়ার কারণে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ না নিলেও ছোট ভাই আজাদ সিদ্দিকীর প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। এমপির অনুসারী ও কর্মীরা আনারসের ভোট কাজ করেন।
এদিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মোল্লার পক্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা একাট্টা হয়ে মিটিং, মিছিল ও গণসংযোগ করেছেন। চেয়েছেন ভোট। সাবেক সংসদ সদস্য হাসান ইমাম খান সোহেল হাজারি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মোজহারুল ইসলাম তালুকদার, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনসার আলী ও জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক আবু নাসেরসহ বিভিন্নস্তরের নেতাকর্মীরা আনোয়ার মোল্লার পক্ষে কাজ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা সিদ্দিকী পরিবারের কালিহাতী তথা টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে বিশাল প্রভাব রয়েছে। এই পরিবারের বড় ছেলে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী কালিহাতী থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে পাঁচবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী ১৯৮৬ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন। বিগত ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রিত্ব পান। আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য পদ লাভ করেন। বিগত ২০১৪ সালে বিদেশে হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করায় তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার ও মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করা হয়। লতিফ সিদ্দিকী এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। তিনি ট্রাক প্রতিক নিয়ে ৭০ হাজার ৯৪০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন।
তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার প্রার্থী ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের টানা ৩২ বছর ধরে সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোজাহারুল ইসলাম তালুকদার। তিনি পান ৫৪ হাজার ৭৫ ভোট। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায় এবং দলের একটি শক্তিশালী গ্রুপ ট্রাকের পক্ষে সরাসরি কাজ করে। এ সময় লতিফ সিদ্দিকীর পাশে ছিলেন ছোট ভাই কাদের সিদ্দিকী ও আজাদ সিদ্দিকী। এবার আজাদ সিদ্দিকী তাঁর বড় দুই ভাইয়ের সমর্থন নিয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করেন। উপজেলার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন সিদ্দিকী পরিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো কালিহাতী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিজয়ী হয়ে তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য ধরে রাখল। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এ পরাজয় কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। যদিও দুটি নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ সিদ্দিকী পরিবারের পক্ষে কাজ করেছে। সেখানে নৌকা প্রতিকে নির্বাচিত কয়েকজন চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদধারী নেতারাও রয়েছেন।
কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মোল্লা টাঙ্গাইল নিউজবিডিকে বলেন, যারা এমপি নির্বাচনে (ট্রাকের) ইলেকশন করেছে, তারাই উপজেলা নির্বাচনে (আনারসের) নির্বাচন করেছে। এ দুটি নির্বাচনে পরাজয়ের কারনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ অবশ্যই ধাক্কা খেয়েছে। বড় ভাই এমপি হওয়ায় ছোট ভাইতো নির্বাচনে কৌশলগত কারনে সুবিধা পাবেই। উপজেলা নির্বাচনের পর তার কয়েকজন কর্মীকে মারধরের অভিযোগ করেন আনোয়ার মোল্লা।
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক আবু নাসের টাঙ্গাইল নিউজবিডিকে বলেন, সকল পরাজয়ের গ্লানি থাকে, যা নেতাদের চেয়ে কর্মীরা বেশি বয়ে বেড়ায়। বর্তমানে কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা স্বাভাবিক কারনেই হতাশ এবং নানাভাবে বিভক্ত। আগামী দিনে দলকে ঐক্যবদ্ধ করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মোজহারুল ইসলাম তালুকদার টাঙ্গাইল নিউজবিডিকে বলেন, কালিহাতীর কতিপয় নেতার বেইমানীর কারনে জাতীয় নির্বাচনে এখানে (নৌকা) হেরেছে। এমপি এবং উপজেলা নির্বাচনে হারের কারনে আমরা সাময়িক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের নেতা। তবে সিদ্দিকী পরিবারের দুই ভাইয়ের কারনে আওয়ামী লীগের প্রতি অন্যায়-অবিচার হলে সেটা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করবো।
নব-নির্বাচিত কালিহাতী উপজেলা চেয়ারম্যান আজাদ সিদ্দিকী টাঙ্গাইল নিউজবিডিকে বলেন, কালিহাতীর মানুষ সিদ্দিকী পরিবারকে ভালবাসে। আমরাও কালিহাতীর মানুষকে আমাদের পরিবার মনে করি। আমার পরিবার মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুর স্নেহ পেয়েছে। আমরা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বাইরের কেউ না। কালিহাতীর মানুষ ভোট দিয়ে আমাদেরকে তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে কাঙিক্ষত কালিহাতী গড়ে তুলবো। আমার কর্মীদের মারধর ও হুমকি দেওয়ার প্রতিবাদে সভা করেছে স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাৎ হুসেইন টাঙ্গাইল নিউজবিডিকে বলেন, এমপি এবং উপজেলা দুটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছে। এ উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে মাহমুদুল হাসান দীপুল (তালা) ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ফাতেমা খাতুন বৃষ্টি (ফুটবল) বিজয়ী হয়েছেন। ১৩টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত কালিহাতী উপজেলায় মোট ভোটার ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯২ জন।