স্টাফ রিপোর্টার ॥
কোরবানি- অর্থ উৎসর্গ, উপঢৌকন, সান্নিধ্য লাভের উপায়, ত্যাগ করা, পশুত্বকে বিসর্জন ইত্যাদি। হজরত ইব্রাহিম (আ.) তার ছেলে হজরত ইসমাইলকে (আ.) আল্লাহর শানে কোরবানি করার উদ্যোগ নেন। সেই থেকে ইসলাম ধর্মে কোরবানি প্রচলন শুরু হয়, এমন ধারণাই বহুল প্রচলিত। তবে ওই ঘটনাই ইসলাম ধর্মে প্রথম কোরবানির ঘটনা নয়। কারণ, ইসলাম ধর্মের প্রথম নবী হজরত আদম (আ.)-এর সময়ও কোরবানির প্রথা প্রচলিত ছিল। আবুল ফিদা হাফিজ ইবনে কাসির দামেস্কির মতে, আদম তাদের দুজনকে (হাবিল এবং কাবিল) কোরবানি করার আদেশ দিয়ে নিজে হজ করার জন্য মক্কায় চলে যান। আদম চলে যাওয়ার পর তারা কোরবানি করেন। হাবিল একটি মোটা তাজা বকরি কোরবানি করেন। তার অনেক বকরি ছিল। আর কাবিল কোরবানি দেন নিজের উৎপাদিত নিম্নমানের এক বোঝা শস্য। তারপর আগুন হাবিলের কোরবানি গ্রাস করে নেয়। আর কাবিলের কোরবানি অগ্রাহ্য করে। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ২১৭) আর ঈদুল আজহার দিন থেকে কোরবানির দিনগুলোয় নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য জবেহ করাই হচ্ছে কোরবানি। ইসলামি শরিয়তে এটি ইবাদত হিসেবে সিদ্ধ, যা কোরআন, হাদিস ও মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্য দ্বারা প্রমাণিত। কোরআন মাজিদে এসেছে- ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশে সালাত আদায় করো ও কোরবানি করো।’ (সুরা কাউসার : আয়াত ২)
১০ জিলহজের ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন পুরুষ ও নারীর কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ৭ ভরি সোনা অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ সম্পদ থাকবে তার কোরবানি করা ওয়াজিব।
টাকাপয়সা, সোনা-রুপার অলঙ্কার, ব্যবসায়িক পণ্য, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি, শৌখিন বা অপ্রয়োজনী আসবাবপত্র এসব কিছুর মূল্য কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।
কোরবানির শর্তাবলি
কোরবানি করার জন্য নির্দিষ্ট পশু রয়েছে। তবে এসব পশুর বয়স এবং এক পশুতে কজন অংশগ্রহণ করতে পারবে, এ সম্পর্কে ইসলামের অনেক দিকনির্দেশনা রয়েছে। আর তা হলো-
কোরবানির পশু
এমন পশু দ্বারা কোরবানি দিতে হবে, যা ইসলামি শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেগুলো হলো- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। এগুলোকে কোরআনের ভাষায় বলা হয় ‘বাহিমাতুল আনআম।’ হাদিসে এসেছে- ‘তোমরা অবশ্যই নির্দিষ্ট বয়সের পশু কোরবানি করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ-শাবক কোরবানি করতে পারো।’
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ছাড়া অন্য কোনো জন্তু কোরবানি করেননি ও কোরবানি করতে বলেননি। তাই কোরবানি শুধু এগুলো দিয়েই করতে হবে।
ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতে, কোরবানির জন্য সর্বোত্তম জন্তু হল শিংওয়ালা সাদা-কালো দুম্বা। কারণ রাসলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরনের দুম্বা কোরবানি করেছেন বলে বোখারি ও মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে।
উট, গরু ও মহিষ সাত ভাগে কোরবানি দেওয়া যায়। হাদিসে এসেছে- ‘আমরা হুদাইবিয়াতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। তখন আমরা উট ও গরু দ্বারা সাতজনের পক্ষ থেকে কোরবানি দিয়েছি।’
গুণগত দিক থেকে উত্তম হলো- কোরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশতসম্পন্ন, নিখুঁত, দেখতে সুন্দর হওয়া।
কোরবানির পশুর বয়স
কোরবানির পশু পরিপূর্ণ বয়সের হতে হবে। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে কোরবানির পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরি। আর তা হলো-
– উট : পাঁচ বছরের হতে হবে।
– গরু-মহিষ : দুই বছরের হতে হবে।
– ছাগল-ভেড়া-দুম্বা : এক বছর বয়সের হতে হবে।
পশু দোষ-ত্রুটিমুক্ত হতে হবে
কোরবানির পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। হাদিসে এসেছে-
সাহাবি হজরত আল-বারা ইবনে আজেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন তারপর বললেন, চার ধরনের পশু, যা দিয়ে কোরবানি জায়েজ হবে না। অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে পরিপূর্ণ হবে না। (আর তা হলো)-
– অন্ধ, যার অন্ধত্ব স্পষ্ট।
– রোগাক্রান্ত, যার রোগ স্পষ্ট।
– পঙ্গু, যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং
– আহত, যার কোনো অঙ্গ ভেঙে গেছে। নাসাঈর বর্ণনা ‘আহত’ শব্দের স্থলে ‘পাগল’ উল্লেখ আছে।
কোরবানি মাকরুহ হবে
আবার পশুর এমন কতগুলো ত্রুটি আছে, যা থাকলে কোরবানি আদায় হবে কিন্তু তা মাকরুহ হবে। এসব দোষত্রুটিযুক্ত পশু কোরবানি না করাই ভালো। আর তা হলো-
– পশুর শিং ভাঙা।
– কান কাটা।
– লেজ কাটা।
– ওলান কাটা কিংবা লিঙ্গ কাটা ইত্যাদি।
পরিপূর্ণ মালিকানা থাকা কোরবানিদাতা যে পশুটি কোরবানি করবেন, তার ওপর কোরবানিদাতার পরিপূর্ণ মালিকানাস্বত্ব থাকতে হবে। যদি এ পশু বন্ধকের পশু, কর্জ করা পশু বা পথে পাওয়া পশু হয় তবে তা দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না।
কোরবানির নিয়মাবলি
মুখের উচ্চারণ দ্বারা নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। এভাবে বলা যায়, ‘এই পশুটি আমার কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট করা হলো।’ তবে ভবিষ্যতের জন্য নির্দিষ্ট করা যাবে না। এমন বলা যে, ‘আমি এই পশুটি কোরবানির জন্য রেখে দেব।’
কাজের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা যায়। যেমন : কোরবানির নিয়তে পশু কেনা অথবা কোরবানির নিয়তে জবেহ করা। যখন পশু কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট করা হয়, তখন কিছু বিষয় কার্যকর হয়ে যায়। আর তা হলো-
প্রথমত : এই পশু কোরবানি ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। দান করা যাবে না। বিক্রি করা যাবে না। তবে কোরবানি ভালোভাবে আদায় করার জন্য তার চেয়ে উত্তম পশু দ্বারা পরিবর্তন করা যাবে।
দ্বিতীয়ত : যদি পশুর মালিক মারা যায় তবে তার ওয়ারিশদের দায়িত্ব হলো এ কোরবানি বাস্তবায়ন করা।
তৃতীয়ত : এ পশুর থেকে কোনো ধরনের উপকার ভোগ করা যাবে না। যেমন- কোরবানির পশুর দুধ বিক্রি করা যাবে না। কৃষিকাজে ব্যবহার করা যাবে না। সাওয়ারি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। পশম বিক্রি করা যাবে না। যদি পশম আলাদা করে তাবে তা সদকা করে দিতে হবে বা নিজের কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারবে কিন্তু বিক্রি করা যাবে না।
চতুর্থত : কোরবানিদাতার অবহেলা বা অযত্নের কারণে যদি কোরবানির নির্ধারিত পশুটি দোষযুক্ত হয়ে পড়ে, চুরি হয়ে যায় কিংবা হারিয়ে যায়, তবে কোরবানিদাতার কর্তব্য হবে অনুরূপ বা তার চেয়ে ভালো একটি পশু ক্রয় করা। আর যদি অবহেলা বা অযত্নের কারণে না হয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে দোষযুক্ত হয়, তবে এই দোষযুক্ত পশু কোরবানি করা যাবে।
যদি পশুটি হারিয়ে যায় অথবা চুরি হয়ে যায় আর কোরবানিদাতার ওপর আগে থেকেই কোরবানি ওয়াজিব হয়ে থাকে, তাহলে সে কোরবানির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করবে।
আর যদি আগে থেকে কোরবানি ওয়াজিব ছিল না কিন্তু সে কোরবানির নিয়তে পশু ক্রয় করে থাকে তবে চুরি হয়ে গেলে বা মরে গেলে অথবা হারিয়ে গেলে তাকে আবার পশু কিনে কোরবানি করতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহ মানুষের রিজিকে ও প্রাকৃতিক সম্পদে বরকতদান করেন। সবকিছুর মধ্যেই আল্লাহর হিকমত ও প্রজ্ঞা লুকায়িত। মানুষের অনুধাবন-ক্ষমতা খুবই কম। এজন্যই বিনা-প্রশ্নে আল্লাহ আদেশ-নিষেধ পালন করে যাওয়াই হলো একজন মুমিনের একমাত্র কর্তব্য। হে আল্লাহ! মুসলিম উম্মাহকে যথাযথ শর্ত ও নিয়ম মেনে কোরবানির পশু কেনার ও কোরবানি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।