হাসান সিকদার ॥
আমার তো অনেক আশা ছিল। আমার ছেলে পড়ালেখা করে অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমাদের অভাব-অনটন দূর করবে। সে ইচ্ছা যে এভাবে ফলে যাবে, তা কে জানত। এখন আমি কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবো। আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচবো। আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। ছেলেকে হারিয়ে বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন নিহত আহনাফ আবীর আশরাফুল্লাহ’র (৩০) মা আছিয়া খাতুন (৬৩)। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মা এখন দিশাহারা। নি:স্ব তার পরিবার। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার বারপাখিয়া গ্রামের হারুন অর রশীদ ও আছিয়া খাতুন দম্পত্তির তৃতীয় সন্তান আহনাফ আবীর আশরাফুল্লাহ।
জানা যায়, গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আনন্দ মিছিলে পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় সাভারের বাইপাইল এলাকায় শিক্ষার্থী আহনাফ আবীর আশরাফুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
সরেজমিনে তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি ঘরে তার মা শুয়ে কান্না করছে। আর ছেলের কথা বলছে। তাদের বাড়িতে জরাজীর্ণ তিনটি ঘর রয়েছে। ছুটিতে বাড়ি আসলে জরাজীর্ণ একটি ঘরে আহনাফ আবীর আশরাফুল্লাহ থাকতো। আর একটি ঘরে তার বোন জামাইরা আসলে তারা থাকতো। বাড়িতে এখন তার মা ও বোন বসবাস করছেন।
পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, তার খালু শাহজাহান মিয়ার কোন সন্তান না থাকায় ৩০ বছর আগে মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলা থেকে তার খালু শাহজাহান মিয়া আহনাফ আবীর আশরাফুল্লাহর পরিবারের সবাইকে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার বারপাখিয়া গ্রামে নিয়ে আসেন। তারপর থেকেই তারা এখানেই বসবাস করছেন। আহনাফ আবীর আশরাফুল্লাহ’র বৃদ্ধ বাবা হারুন অর রশীদ পরিবারের কোন দেখভাল করেন না। অভাব-অনটনের মধ্যে তার মা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুরআন পড়িয়ে সংসার চালান। আহনাফ আবীর আশরাফুল্লাহও কিছু কিছু টাকা দিত। এ দিয়েই তাদের সংসার চলতো। যখন আহনাফ আবীর আশরাফুল্লাহ বাড়িতে মাঝে মধ্যে আসতো তখন জরাজীর্ণ ঘরেই থাকতেন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আহনাফ আবীর আশরাফুল্লাহ মা এখন পাগল প্রায়।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, দেলদুয়ার উপজেলার বারপাখিয়া গ্রামের শহীদ আহনাফ আবীর আশরাফুল্লাহ’র বাড়ি। তারা তিন বোন ও এক ভাই। আহনাফ আবীর আশরাফুল্লাহ তৃতীয় সন্তান ছিলেন। সবার ছোট বোন সখীপুর মহিলা আবাসিক কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আহনাফ আবীর আশরাফুল্লাহ ২০১১ সালে দেলদুয়ার সরকারি সৈয়দ আব্দুল জব্বার বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। মুন্সিগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ২০১৬ সালে ইলেকট্রিক্যাল বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। তারপর মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
ছোট বোন তাসফিয়া জিন্নাত শাফী বলেন, ভাইকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। পরিবারের সবার ইচ্ছে ছিল ভাই বড় হয়ে মায়ের সব স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সে দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। এখন আর কেউ রইলো না আমাদের দেখার, কে দেখবে আমাদের। কিভাবে সংসার চলবে আমাদের। সরকার যদি আমাদের দিকে তাকায়, তাহলে আমরা ভালভাবে বাঁচতে পারবো। আমিও পড়াশোনা চালাতে পারবো। আমার ভাইকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে তাদের কঠিন বিচার চাই, তাদের ফাঁসি চাই। তিনি আরও বলেন, আমার ভাই দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। তার নাম যেন মুছে না যায়, সেজন্য আমাদের দাবি দেলদুয়ারে যে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম রয়েছে সেটার নাম পরিবর্তন করে আহনাফের নামকরণ করা হোক। আমার ভাইয়ের কবরটি যেন মুছে না যায় সেজন্য সরকারের কাছে দাবি কবরটি যেন সংরক্ষণ করা হয়। সারাজীবন যেন চিহ্ন থাকে এটা আমার ভাইয়ের কবর।
আহনাফের সহপাঠী ডা. আলম মিয়া বলেন, আহনাফ অনেক ভালো ছেলে ছিল। ছাত্রও অনেক ভালো ছিল। আহনাফ যে এভাবে গুলিতে মারা যাবে আমরা মেনেই নিতে পারছি না। যখন ওর মৃত্যুর খবর শুনতে পেলাম আমি খুবই মর্মাহত হই। আহনাফ ছাড়া তাদের পরিবারকে দেখার মতো কেউ নাই। ছোট একটি বোন পড়াশোনা করছে, কে দেখবে ওদের পরিবারকে। দেখার মতো কেউ রইলো না। সরকারের কাছে দাবি আহনাফের পরিবার যেন চলতে পারে কোন একটা ব্যবস্থা করে দিক। আহনাফকে যারা হত্যা করেছে তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হোক। কেউ জানি ছাড়া না পায় এটাই সরকারের কাছে জোড় দাবি জানাচ্ছি।
সহপাঠী রিফাত ও সুজন মিয়া বলেন, আহনাফের সাথে পড়াশোনা ও এক সাথে বেড়ে উঠা। ও অনেক মেধাবী ছাত্র ও শান্ত মেজাজের ছেলে ছিল। আহনাফকে এভাবে হত্যা করা হবে কখনো চিন্তাও করি নাই। ও অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছে। ওর বাবা ওদের খোঁজখবর নেন না। ওর মা অন্যের বাড়ি কুরআন পড়িয়ে সংসার চালাতো। ওর মা, তিন বোন ও আহনাফকে অনেক কষ্ট করে বড় করেছে। ও যা ইনকাম করতো কিছু কিছু টাকা বাড়িতে দিত। আর ও পড়াশোনার খরচ চালাতো। আহনাফ মারা যাওয়াতে তার পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। সরকারের কাছে দাবি ওর মা ও বোন যেন সুন্দরভাবে চলতে পারে সেজন্য প্রতি মাসে চলার মতো খরচ দেয়া হয়। আহনাফকে যারা হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। দেলদুয়ার স্টেডিয়াম ও হাসপাতাল সড়ক যেন আহনাফের নামে করা হয় সরকারের কাছে জোড় দাবি জানাচ্ছি।
নিহত আহনাফের মা আছিয়া খাতুন বলেন, আমার ছেলে কিছু কিছু টাকা দিত। আর আমি কুরআন পড়িয়ে যা টাকা পাইতাম তা দিয়েই আমাদের সংসার চলতো। সরকার যদি আমাদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে মেয়েকে মিয়ে একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারবো। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে আমি তাদের বিচার চাই। আমার ছেলে তো দেশের জন্য জীবন দিছে। তাকে যেন শহীদের মর্যাদা দেয়া হয়। তার স্মৃতি ধরতে রাখতে দেলদুয়ার উপজেলায় যে স্টেডিয়াম আছে। সেটার নাম যেন আমার ছেলের নামে করা হয় এটা সরকারের কাছে দাবি।
উল্লেখ্য, গত (৫ আগস্ট) সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আনন্দ মিছিলে অংশ নেয় আহনাফ। পরে ছাত্র-জনতা ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষে সাভার বাইপাইল এলাকায় আহনাফ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরের দিন (৬ আগস্ট) টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার বারপাখিয়া গ্রামের বাড়ি স্থানীয় করবস্থানে দাফন করা হয়।