হাবিবুর রহমান, মধুপুর ॥
লাল মাটির বসবাসরত গারো মান্দি কোচ নারীরা যুগ যুগ ধরে কৃষি কাজের সাথে জড়িত। সংসারের যাবতীয় কাজ নারী পুরুষ মিলেই করে থাকে। জমিতে ধানের চারা, কাটা, বাড়িতে আনা নেওয়া বাগান নিড়ানি বাগান করা সবজি চাষ থেকে শুরু করে গৃহস্থালির কাজগুলো মিলে করার দৃশ্য দেখা যায়। এখন বাড়িতে জৈব সার তৈরিও হচ্ছে নারীদের হাতে। সরকারের পাশাপাশি এএলআরডি, কারিতাস, সালোমসহ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা নারীদের কৃষি কাজের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল করতে বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ। ফলের চারা লাগানো, হাঁস-মুরগি পালনসহ কেঁচো জৈব সার তৈরিতে উদ্ভুদ্ধ করে। প্রশিক্ষণসহ কেঁচো বীজ দিয়ে সহযোগিতা করেছে।
এভাবে টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ের ভুটিয়া, আমলিতলা, গাছাবাড়ি, ইদিলপুর, রাজাবাড়ি, গায়রা, টেলকি, পীরগাছাসহ কয়েক গ্রামে এখন চলছে কেঁচো জৈব সার তৈরি। জৈব সারের চাহিদা থাকলেও ভালো দাম পাচ্ছে না। খুচরা দামে বাড়ি থেকে বিক্রি হলেও সেলস সেন্টার না থাকায় পাইকারি বিক্রি করতে না পারায় ন্যায্য দাম পাচ্ছে না বলে মনে করছেন নারী উদ্যাক্তারা। তাদের দাবি সরকারী বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারা আরো এগিয়ে যাবে, পাবে ন্যায্যমূল্য। বেকারত্ব দূর হবে বাড়বে জৈবিক উপায়ে ফল ফসলের চাষাবাদ এমনটাই মনে করেছেন তারা। তবে কৃষি বিভাগ বলছে কেঁচো সার উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হয়ে থাকে।
মধুপুর উপজেলার অরণখোলা ইউনিয়নের ভুটিয়া গ্রামে গিয়ে জানা যায়, কোচ নারীদের কেঁচো দিয়ে জৈব সার উৎপাদনের গল্প। নারীরা জানালেন, এ কাজে বাড়তি শ্রম না থাকায় নিজেরাই জৈব সার প্রক্রিয়া করে থাকে। পুরো প্রক্রিয়াই নারীদের হাতে। গ্রামে এক সময় তাদের বসবাস বেশি থাকলেও এখন মাত্র ৪০-৫০ পরিবারের বসবাস। বাঁশ, বেতের পেশা থাকলেও উপকরণের দাম বৃদ্ধি ও প্লাস্টিকের দাপটের কারণে পেশা ছেড়ে কেউ কৃষি, কেউ দিন মজুরি, আবার কেউ ভ্যান-রিকসা চালনার কাজ করে। নারীরা বাড়ির কাজ আবার কেউ দিন মজুরি করে।
কয়েক বছর আগে মধুপুর জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সাবেক সভাপতি অজয় এ মৃ এএলআরডি নামক সংস্থা থেকে ভুটিয়াসহ কয়েকটি গ্রামে নারীদের কেঁচো পালনের উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে কেঁচো দেন। সে থেকে তাদের গ্রামে কেঁচো দিয়ে জৈব সার তৈরি শুরু। কয়েক বছর আগে অনেকেই করলেও এখন হাতে গোনা ৫-৭ জন নারী ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি করছেন। বসত বাড়ির আশপাশে চারি, বালতি, রিংসহ নানা উপকরণে নিজের গোয়ালের গোবর দিয়ে কেঁচোর মাধ্যমে সার তৈরি করে। কেঁচো দিয়ে জৈব সার তৈরি করতে প্রায় এক মাসের মতো সময় লাগে। এ সার তারা স্থানীয় কৃষকদের কাছে ৬শ’ থেকে হাজার টাকা মন দরে বিক্রি করতে পারেন। এমনটাই জানালেন গ্রামের কয়েকজন উদ্যোক্তা।
গৌরি রানী বর্মন (৪০) জানান, তার ১০-১২ চারি রয়েছে। এ থেকে যে সার আসে, তা নিজেদের জমিতে প্রয়োগের পর বাড়তি সার বিক্রি করে দেন। সার বিক্রির টাকা সংসারের কাজে ব্যয় করেন। এতে তিনি ভালোই লাভ পাচ্ছেন। প্রমিলা রানী (৪২) জানালেন, বাড়ির কাজের ফাঁকে ফাঁকে দিনে দুই একবার সময় দিয়ে থাকেন। ঘরের বারান্দায় কেঁচো সার উৎপাদনের রিং থাকায় যে কোন সময় দেখতে পারেন। তিনি জানালেন বাড়ি বসে থাকার চেয়ে কিছু সার পেয়ে নিজের কাজে লাগান। আবার বিক্রি করে কিছু টাকাও আসে। এতে সন্তানদের পড়াশোনা, নিজের হাত খরচ চালাতে কোন সমস্যা হয় না। শুধু ভুটিয়াই নয়, মধুপুরের আরো কয়েক গ্রামে নারীরা করছে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি। এতে একদিকে নারীদের কিছুটা অর্থনৈতিক লাভ হচ্ছে। অপরদিকে মাটিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ছে। মাটির গুনাগুন বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে ফসলের ফলন।
গারো নারীদের প্রতিনিধিত্বকারি সংগঠন আচিক মিচিক সোসাইটি নির্বাহী পরিচালক সুলেখা ম্রং বলেন, গারো কোচ নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে কেঁচো সার উৎপাদন করে নিজেদের প্রয়োজন মিটানোর পর বিক্রি করছে। এতে সংসারে স্বামীকে সহযোগিতার পাশাপাশি নিজের ছোট খাটো খরচ চালাতে সহজ হয়। কারিতাসের টেলকি বাজারের আইসিটি সেন্টারের তন্দ্রা দালবত জানালেন, কারিতাসের প্রকল্পের মাধ্যমে জৈব সার নিরাপদ সবজি উৎপাদনে তারা কাজ করেন। তাদের এলাকায়ও কয়েকজন গারো মান্দি নারী এ সার উৎপাদন করে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক আহসানুল বাসার বলেন, মাটির সুস্বাস্থ্যের জন্য জৈব সার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জৈব সার ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদনকারীদের পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে থাকে। নারীরা নিজের সংসারের কাজে পাশাপাশি কেঁচো জৈব উৎপাদন করে নিজে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি জমিতে জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মধুপুর গড়ের কৃষি জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পাবে। নারীরাও এগিয়ে যাবে এমনটাই জানিয়ছেন তিনি।
সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাড়বে নারীদের কেঁচো জৈব সার উৎপাদন, বাড়বে নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান। মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পাবে, বাড়বে ফসলের ফলন ও উৎপাদন।