হাবিবুর রহমান, মধুপুর ॥
পড়নে দক শাড়ী, দক মান্দি। কারো লাল, কারো সবুজ,কারো নীলসহ বিভিন্ন রঙের মান্দি নারীদের পড়নে দকশাড়ী ও দক মান্দা। মাথায় উপরে কপালে প্যাচ দিয়ে পিঠে বাঁশের তৈরি খাচির মতো। এ বিশেষ ধরনের খাচির নাম খক মান্দি। কোন কোন এলাকায় খকখ্রেং বা খক বলে থাকে। তবে মধুপুর অঞ্চলে খক মান্দি বলে থাকে আবিমার মান্দিরা। আবার শেরপুর অঞ্চলে খকখ্রেং বা খক বলে থাকে। খকখ্রেং গারো বা মান্দি শব্দ। খকও মান্দি শব্দ। গারো সম্প্রদায়ের নানা পূজা পার্বন আত্মীয় স্বজন আত্মীয় গোষ্ঠীদের বাড়িতে বিয়ে শ্রাদ্ধ থেকে শুরু করে সাংসারেক আচার অনুষ্ঠান ও ওয়ানগালাতে নানা শস্য খাবার জিনিসপত্র বহনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে এ খক মান্দি। মান্দিদের নানা অনুষ্ঠানে পিঠে খক মান্দি নিয়ে নৃত্য পরিবেশন করতে দেখা যায়। মান্দিরা তাদের সাংসারেক রীতি নীতি ও ঐতিহ্য মনে করে তারা বংশ পরম্পরায় ব্যবহার করে যাচ্ছে। খক মান্দি তৈরির কারিগরের অভাবে ব্যবহার আগের চেয়ে কম বলে মনে করেন অনেকেই। তবে এখন মান্দিদের মধ্যে অনেকেই নতুনরূপে আধুনিক মানের খক মান্দি তৈরি শুরু করেছে।
মধুপুরের বিভিন্ন গারো বা মান্দি পল্লী ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, খক মান্দি তাদের আদি ঐতিহ্য। বংশ পরম্পরায় তারা বিয়ে সাদিতে মেয়েদের জন্য জামাই আনতে বেয়াই বাড়িতে যাওয়ার সময় খক মান্দিতে শুকর, মোরগ, চাল, চিনি, চা, পান, সুপারি, মিষ্টি, চু (পানীয়) সহ নানা জিনিসপত্র ভরে নতুন গামছা বা কাপড় দিয়ে ঢেকে নিয়ে যাওয়া যায়। আবার ফেরার সময় বেয়াই বাড়ি থেকে ভাত তরকারিসহ নানা খাদ্য সম্মান করে দিয়ে দেয়। ফিরে এসে আবার ঘরের মধ্যে যত্ন করে রেখে দেন। এটা কোন সাধারণ কাজে ব্যবহার হয় না। শ্রাদ্ধ বাড়িতে আত্মীয়দের জন্য খক মান্দিতে ভরে শুকর মোরগ চাল চিনি চা পান সুপারি চুসহ অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে জমা দিলে নাম লিখে নাম রেখে দেন। পরে আবার নিজেদের বিয়ে সাদি শ্রাদ্ধতে ঐ সম পরিমান সামগ্রী নিয়ে তারা আসে। এই রীতিতে চলে আসছে তাদের সামাজিক অনুষ্ঠানসহ নানা পর্ব। এসব সাংসারেক কাজে এই খক মান্দি ব্যবহার হয়ে থাকে। মধ্যম সারি থেকে উপর দিকে বৃত্তবান মান্দিদের প্রায় বাড়িতেই রয়েছে খক মান্দি। ওয়ানগালা উৎসবসহ নানা উৎসবেও ব্যবহার করা হয় খক মান্দি।
পীরগাছা গ্রামের চিত্রা নকরেক জানান, তাদের ঐতিহ্যের খক মান্দি। তারা বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে জিনিসপত্র বহন করার কাজে ব্যবহার করে থাকে। তিনি খক মান্দিসহ মান্দিদের বাঁশের তৈরি নানা জিনিসপত্র তৈরি করছে বলে জানান। মরিয়ম নগরের শিল্পী ম্রং জানান, তাদের এলাকায় খক গ্রেং বা খক বলে থাকে। আদি থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে। এখন অনেকটা কমে যাচ্ছে। তবে কোচদের খক ব্যবহার করতে দেখা যায়। তার মতে, পার্বত্য ও সিলেট এলাকায় বেশি ব্যবহার হয়। জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সাবেক সভাপতি অজয় এ মৃ বলেন, খক মান্দি তাদের বংশপরম্পরায় একটি ঐতিহ্য। এটা অনেক সম্মানের। আত্মীয় স্বজন বাড়ি বিয়ে শ্রাদ্ধসহ নানা উৎসবে খক মান্দিতে উপহার সামগ্রী নিয়ে যাওয়া অনেক সম্মান ও ঐতিহ্যের। তিনি মনে করেন, আগে চেয়ে এর ব্যবহার কমেছে। তারমতে, খক মান্দি তৈরির কারিগরের অভাবে ব্যবহার কমেছে। তার দাবি, সরকারী বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তাদের আদি ঐতিহ্যে খক মান্দি ব্যবহার বাড়বে এবং ঐতিহ্যের খক মান্দি তাদের সমাজে সগৌরবে আগামী প্রজন্মের কাছে সমাদৃত হবে যুগ যুগ টিকে থাকবে বলে তিনি মনে করেন।
আচিক মিচিক সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সুলেখা ম্রং বলেন, বিয়ে সাদিতে গারো রীতিতে মেয়েদের জন্য জামাই আনতে বেয়াই বাড়িতে যাওয়ার সময় খক মান্দিতে শুকর, মোরগ, চাল, চিনি, চা, পান, সুপারি, মিষ্টি, চু (পানীয়) সহ নানা জিনিসপত্র ভর্তি করে নতুন গামছা বা কাপড় দিয়ে ঢেকে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার ফেরার সময় বেয়াই বাড়ি থেকে ভাত তরকারিসহ নানা খাদ্য সামগ্রী দিয়ে দেয়। দাওয়াত শেষে ঘরের মধ্যে যত্ন করে রেখে দেন। এটা কোন কোন সাধারণ কাজে ব্যবহার হয় না। আবার, শ্রাদ্ধ বাড়িতে আত্মীয়দের জন্য খক মান্দিতে ভরে শুকর মোরগ চাল চিনি চা পান সুপারি চুসহ অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে জমা দিলে নাম লিখে নাম রেখে দেন। পরে আবার নিজের বিয়ে সাদি শ্রাদ্ধতে ঐ সম পরিমান সামগ্রী নিয়ে তারা আসে। এই রীতিকে চলে তাদের সামাজিক অনুষ্ঠানসহ নানা পর্ব। এসব সম্মানের কাজে এই খক মান্দি ব্যবহার হয়ে থাকে। তার মতে, প্রায় মধ্যম সারি থেকে বৃত্তবান মান্দিদের প্রায় বাড়িতেই রয়েছে খক মান্দি।
সাংসারেক ধর্মের গারো রীতি নীতি সামাজিক সাংস্কৃকি ও ধর্মীয়সহ নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় এ বিশেষ ধরনের খক মান্দি। আগামী প্রজন্মের কাছে টিকিয়ে রাখতে হলে দরকার সচেতনতা, কাঁচামাল ও খক মান্দি তৈরির কারিগর। এজন্য সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।