স্টাফ রিপোর্টার ॥
টাঙ্গাইলের মধুপুর বনাঞ্চলের ধরাটি গ্রামের পূর্ণ চিসিক ও সতেন্দ্র নকরেকের চার কন্যা যথাক্রমে-ফ্রান্সিলিয়া, মালিতা, নমিতা ও মালিনা এবং দুই পুত্র পারমেল ও সেবাস্তিন। মাতৃতান্ত্রিক নিয়ম মানুযায়ী ছয় সন্তানের সবাই মায়ের বংশ পদবি চিসিক গ্রহণ করেছে। ঐতিহ্য অনুযায়ী মা হলেন সম্পদের মালিক। তিনি যে কন্যাকে নকনা নির্বাচন করবেন, তিনিই হবেন সম্পত্তির পুরো মালিক। অন্যান্য ভাইবোনরা মায়ের সম্পত্তি পান না। তবে মা সদয় হলে অন্য সন্তানদের সম্পত্তির। ছিটাফোঁটা দিতে পারেন। নকনা বিয়ে করে বাড়িতে ঘরজামাই আনেন। নকনাই বাবা-মায়ের দেখাশোনা করেন। আর ভাইয়েরা বিয়ে করে ঘরজামাই হয়ে চলে যান।
জানা যায়, বাংলাদেশে যে অর্ধশতাধিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দেখা মিলে অরণ্যচারি গারোরা তার অন্যতম। একসময়ে শুধু পাহাড়, অরণ্য, নদী আর কৃষির সঙ্গেই তাদের জীবন জড়িত ছিল। কিন্তু কালক্রমে তাদের জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, শিক্ষাদীক্ষা ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক বন্ধন এবং প্রথাগত জীবনাচরণেও ঘটছে নানা রূপান্তর। সুপ্রাচীনকাল থেকেই নারীরা সম্পত্তির মালিক। সামাজিক ভূমি ব্যবস্থাপনা ও মালিকানা প্রথা থাকলেও নারীরা পরিবার, সমাজ ও অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। তাদের নেতৃত্ব ও ভূমিকায় সন্তুষ্ট থাকেন সদস্যরা। এজন্য অধিকাংশ নারীরা সম্মানিত এবং ক্ষমতায়িত। মঙ্গোলীয় জাতি গোষ্ঠীর গারো যাদের মান্দিক বা আচিক নামেও ডাকা হয়। তাদের মূল জনগোষ্ঠীর বসবাস ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ে। তবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনাচরণে ঘটছে নানা রূপান্তর।
গারো নারী উদ্যোক্তা পূর্ণিমা নকরেক জানান, সংখ্যাগরিষ্ঠ গারো নারীর আয়-রোজগারে সংসার চলে। ঘরজামাই প্রথায় স্বামীরাই ঘরের বাচ্চাকাচ্চা সামলায়। তবে শিক্ষিত যুবকরা এখন ঘরজামাই প্রথা মানতে চাচ্ছে না। গারো পাহাড়ের পাদদেশ এবং টাঙ্গাইলের মধুপুর গড় এলাকায় গারোদের দেখা মেলে। গারোদের শতকরা ৯৭ শতাংশ খ্রিষ্টান। কিছু পরিবার প্রাচীন বা সংসার ধর্ম পালন করে থাকেন।
কিন্তু ধর্মীয়ভাবে যাই হোক না কেন, সব গারোই প্রাচীন সংস্কৃতি ও রীতিনীতি পালন করার চেষ্টা করেন। প্রখ্যাত গারো গবেষক সুভাস জেমচাং রচিত 'বাংলাদেশের গারো আদিবাসী' গ্রন্থে বলা হয়, কৃষি এখনো গারোদের অর্থনীতির মূল প্রাণ। দিনে দিনে নতুন প্রজন্মের জীবন-জীবিকায় পেশার ধরণ পালটাচ্ছে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে সংসার পরিচালনায় মায়ের ভূমিকা অনেক। ঐতিহ্য অনুসারে নারীরা সমাজে বাড়তি স্বাধীনতা পেয়ে থাকে। এজন্য নারীরা স্বাধীনভাবে পেশা বেছে নিতে পারছে। গবেষণাধর্মী সংস্থা সেডের তথ্যে বলা হয়, গারো নারীরা মূলত কৃষি পেশার সঙ্গে জড়িত। তবে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় শুধু মধুপুর বনাঞ্চলের দেড় হাজার গারো যুবতি বিউটি পার্লার, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে নার্স, গার্মেন্টস, বেসরকারি সংস্থার কর্মী এবং বিভিন্ন দূতাবাসে কাজ করেন। কেউ আবার বিদেশে যাচ্ছেন। বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় এবং কনভিত্তিক জীবনযাপনের সুযোগ সংকুচিত হওয়ায় গ্রাম ছেড়ে নগরে ভিড় করছে নারীরা।
ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি এডওয়ার্ড নাফাক জানান, নকনা প্রথা কমে যাওয়ায় পারিবারিক ভূসম্পত্তির মালিকানার ধরন বদলে যাচ্ছে। এখনো নারীরা সমাজে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করেন। আধুনিক শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটায় গারো মেয়েরা কৃষিকাজ ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছে। নিজেরা আয়-রোজগার করায় সমাজ ও পরিবারে প্রভাব বাড়ছে।
গারো নারী উদ্যোক্তা পূর্ণিমা নকরেক জানান, সংখ্যাগরিষ্ঠ গারো নারীর আয়-রোজগারে সংসার চলে। ঘরজামাই প্রথায় স্বামীরাই ঘরের বাচ্চাকাচ্চা সামলায়। তবে শিক্ষিত যুবকরা এখন ঘরজামাই প্রথা মানতে চাচ্ছে না।