মোজাম্মেল হক ॥
বটগাছের মাথায় খেজুর গাছ কীভাবে জন্ম নিল? ছেলের প্রশ্নের জবাব দিতে নিজেও গাছটির দিকে অনেকক্ষণ থাকলেন শাকিল মিয়া। দেখলেন বটগাছটি দশ থেকে পনের ফুট পর্যন্ত ডালপালা ছড়িয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে। তারপরই দেখা যায়, তার ভেতর থেকে একটি খেজুর গাছ বেরিয়ে উচ্চতা প্রকাশ করছে। বটগাছে বুক চিড়ের বড় হওয়া খেজুর গাছটি দেখে বিস্মিত হচ্ছে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার আজগানা ইউনিয়ন থেকে কালিয়াকৌর গামী পথচারীরা। সবার প্রশ্ন, বটগাছের মাথায় খেজুর গাছটি জন্মালো কীভাবে? বেঁচে আছে কিভাবে? রস ও খেজুর খাওয়া যায় কি?
উত্তর খুঁজতে গাছের অদূরে গাছটির মালিক মনি মোহনের ছেলে নিমাই বলেন, আমি প্রথমে খেঁজুর গাছটি রোপন করি। পাখির বিষ্ঠা থেকে বটগাছের বিচি খেঁজুর গাছের নিচের দিকে ফেলে। পরবর্তীতে খেজুঁর গাছ জুড়েই বটগাছটি বড় হয়। তিনি খেঁজুর থেকে রস ও মিষ্টি খেঁজুর দুটিই পান। চার মেয়ের বাবা রস দিয়ে গুড় তৈরী করেন। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকী ৩টি পড়াশোনা করছেন। গাছটির পরিচর্চা করতে হয় না।
দেখা যায়, মাটি থেকে বটগাছটি বেড়ে উঠেছে খেজুর গাছটিকে আলিঙ্গন করেই। বটগাছের ছোট ছোট ডালপালা নিচের দিকেই। উপরে বটগাছের ভেতর থেকেই খেজুর গাছ বীর দর্পে মাথা উঁচু করে বের হয়ে তার পাখির পালকের মতো মেলে দিয়েছেন। যেখান থেকে গাছটির মালিক নিমাই রস ও খেজুর পেড়ে খান। তবে বটগাছের সাথে খেজুর গাছটির আলিঙ্গন দেখে তার কেউ বলছেন বিয়ে, কেউ বলছেন প্রেম, কেউ বলছেনবন্ধুত্ব! উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভাষায় এসব কিছুই না। এটা আসলে পরজীবিতা। দুটি গাছ, এক পায়ে দাঁড়িয়ে। জড়াজড়ি করে বেড়ে উঠছে মির্জাপুরের শেষ গ্রাম আজগানা ইউনিয়নের পাকা রাস্তার পাশে কয়েকটি পুকুর সংলগ্ন একটি পুরোনো বাড়ীর পাশে এই দৃশ্য চোখে পড়ে। বটগাছের মাথায় খেজুর গাছ। প্রথমে দেখলে মনে হবে বটগাছের জন্ম আগে, তারপর খেজুঁর গাছ। আসলে খেজুঁর গাছের গোড়ায় বটবৃক্ষের বিচি থেকে বটগাছ বেড়ে উঠেছে খেজুর গাছকে আলিঙ্গন করে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, অসম গোত্রের দুটি বক্ষের এই সম্মিলন সত্যিই সুন্দর। এ রকম প্রাকৃতিক বৈচিত্র যত বেশী থাকবে, তত আমাদের গ্রামের সৌন্দর্য বাড়বে। পরিবেশও সুন্দর হবে। মানুষ ইচ্ছেমত পাহাড়, জলাশয়, মাঠ এসব ধ্বংস করছে। গ্রামের শতায়ু গাছের সংখ্যা কমছে দিন দিন। তাদের রক্ষার কিংবা নতুন করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেই। খেজুর আর বটগাছ যেন বোবা ভাষায় প্রতিবাদ করছে। তাদের প্রতিবাদের ভাষা মানুষ যত তাড়াতাড়ি বুঝবে ততই মঙ্গল।
কৃষি কর্মকর্তা কবির হোসেন বলেন, বটগাছ ও খেজুর গাছের মিলিত বন্ধনে একত্রে মাটির নিচ থেকে তাদের খাদ্য সংগ্রহ করে বেড়ে উঠতে পারে এবং দুটি গাছই পরিমান মতো খাদ্য সংগ্রহ করে এবং খেজুর গাছ থেকে রস এবং খেজুর আশা করা যায়। খেজুর এক ধরনের তালজাতীয় শাখাবিহীন বৃক্ষ। এর বৈজ্ঞানিক নাম ফিনিক্স ড্যাকটিলিফেরা। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সুমিষ্ট ফল হিসেবে এর গ্রহনযোগ্যতা পাওয়ায় অনেক বছর পূর্ব থেকেই এর চাষাবাদ হয়ে আসছে। খেজুর গাছ প্রধানত মরু এলাকায় ভাল জন্মে। খেজুর গাছের ফলকে খেজুররুপে আখ্যায়িত করা হয়। খেজুর গাছে উচ্চতা গড়পড়তা ১৫ মিটার থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর লম্বা পাতা রয়েছে যা পাখির পালকের আকৃতিবিশিষ্ট। দৈর্ঘ্যে পাতাগুলো ৩ থেকে ৫মিটার পর্যন্ত হয়। পাতায় দৃশ্যমান পত্রদন্ড রয়েছে। এক বা একাধিক বৃক্ষ কান্ড রয়েছে যা একটিমাত্র শাখা থেকে এসেছে।
বট তথা বট গাছ। ইংরেজি (ওহফরধহ নধহুধহ) ফাইকাস বা ডুমুর জাতীয় গোত্রের ইউরোস্টিগ্মা উপগোত্রের সদস্য। এর আদি নিবাস হল বঙ্গভূমি। এটি একটি বৃহদাকার বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। বটগাছ খুব বড় জায়গা জুড়ে জমির সমান্তরাল শাখা প্রশাখা বিস্তার করে যারা স্মম্ভমূলের উপর ভর দিয়ে থাকে। পাখিরা ফল খেয়ে বীজ ছড়িয়ে দেয়। পাখিবাহিত এই বীজ দালানের কার্নিশ, পুরনো দালানের ফাটল ও অন্য কোনো গাছের কোটরে সহজেই অঙ্কুরিত হয় এবং আশ্রয়কে গ্রাস করে। উপযুক্ত পরিবেশে একটি বটগাছ পাঁচ থেকে ছয় শত বছর বেঁচে থাকতে পারে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে ধর্মীয় কারণে বটগাছ কাটা নিষিদ্ধ। বটের নানা রকম উপকারিতা রয়েছে। এর কষ থেকে নিম্নমানের রাবার তৈরি হয় এবং বাকলের আঁশ দড়ি ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার্য। এর পাতা কৃষ্টরোগে উপকারী। বটের আঠা পা ফাটা সারায়, বটের ছাল দেহের মেদ কমায়। এছাড়া হাড় মচকে গেলে এর ছাল বেটে গরম করে মালিশ করলে আরাম পাওয়া যায়। খেজুর আর বটগাছের জুটি, তাদের যৌথ জীবন শত শত বছর পার করে দিক। দুই দশক, তিন দশক পার হয়ে শতাব্দীতে এগিয়ে যাক এই কামনায়।