স্টাফ রিপোর্টার ॥
টাঙ্গাইলে পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করে জনবসতি ঘেঁষে ফসলি জমিতে গড়ে উঠছে ৪১১টি ছোটবড় চালকল। এরমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে মাত্র ৬৩টির- অন্য ৩৪৮টি ছাড়পত্র বিহীন। এসব চালকলের (মেজর/অটো/সেমি অটো রাইস মিল) বর্জ্যে নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি, দূষিত হচ্ছে নদী, খালবিল। আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় চালকল স্থাপনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নতুন চালকলে সরকারের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগও দেওয়া হচ্ছে। চালকলের ধোঁয়া ও ছাইয়ে গাছপালার পাতা পর্যন্ত কালো হয়ে গেছে- গাছে ফল ধরে না। এলাকার বয়ষ্ক ও শিশুরা শ্বাসকষ্টে ভুগছে।
জানা যায়, খাদ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স ব্যতিত চালকল চালানোর সুযোগ নেই। অটোমেটিক রাইস মিল স্থাপন করতে হলে কারখানা স্থাপনের দলিলের কপি, বিদ্যুৎ বিলের কপি, পরিবেশের ছাড়পত্র, আর্থিক স্বচ্ছলতার সনদসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র দিয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের নির্ধারিত প্রকৌশলীর কাছে আবেদন করতে হয়। এরপর বয়লার পরিদর্শকের সনদ পেলে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর থেকে চালকলের লাইসেন্স ইস্যু করা হয়। কারখানা চালাতে এসটি লাইনের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ সংযোগের প্রয়োজন হয়। এজন্য বিদ্যুৎ বিলের কপি ও পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া কোন ক্রমেই চালকলের লাইসেন্স দেওয়ার বিধান নেই। তারপরও জেলায় দিন দিন অটোমেটিক চালকলের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। অনেকে অটোমেটিক চালকল চালালেও সঠিক কাগজপত্র না থাকা এবং বছর বছর লাইসেন্স ফি দেওয়া সাশ্রয় করতে লাইসেন্স ব্যতিত চালকল চালাচ্ছেন।
এদিকে, চলতি বছরের (৭ ফেব্রুয়ারি) অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রীসভা কমিটির সভায় (২০২৪ সালের দ্বিতীয় সভা) বিবিধ আলোচনায় বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট কিছু সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত হয়। এরমধ্যে ‘ইকোনমিক জোন বা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত শিল্প এলাকা ছাড়া অন্য কোনো স্থানে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হলে বিদ্যুৎ সংযোগ ও গ্যাস সরবরাহ প্রদান না করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ সংক্রান্ত নিয়ম বহির্ভূতভাবে কেউ কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে’ অন্যতম। এ মর্মে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ (উন্নয়ন-১ অধিশাখা) থেকে উপ-সচিব সাইফুল ইসলাম আজাদ স্বাক্ষরিত একটি পত্র গত ১০ মার্চ বিভিন্ন জেলা সহ বিদ্যুৎ বিভাগের সকল দপ্তরে পাঠানো হয়। টাঙ্গাইলে নির্ধারিত স্থানের বাইরে লোকালয় ঘেঁষে ফসলি জমিতে গড়ে ওঠা নতুন নতুন চালকলে বিগত সরকারের ওই সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
খাদ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, টাঙ্গাইল জেলায় ৪১১টি মেজর, অটোমেটিক, সেমি অটোমেটিক (হাস্কিং বা চাতাল) ও আতপ চালের চালকল রয়েছে। এরমধ্যে টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় একটি অটোমেটিক ও একটি আতপ সহ ১৮টি, সখীপুর উপজেলায় একটি অটোমেটিক সহ ১৬টি, মির্জাপুরে ৭টি, বাসাইলে ৭টি, দেলদুয়ারে ১টি, নাগরপুরে ২টি, কালিহাতী উপজেলায় একটি অটোমেটিকসহ সর্বোচ্চ সংখ্যক ১২৮টি, ঘাটাইলে একটি অটোমেটিকসহ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০৫টি, মধুপুরে দুইটি মেজর ও চারটি অটোমেটিকসহ তৃতীয় সর্বোচ্চ ৫০টি, ধনবাড়ীতে ১৩টি অটোমেটিকসহ ৩৩টি, গোপালপুরে একটি অটোমেটিকসহ ২৭টি এবং ভূঞাপুর উপজেলায় ১৭টি চালকল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বা লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ৬৩টির। অন্য ৩৪৮টি চালকলের পরিবেশ অধিদপ্তরের কোন ছাড়পত্র নেই।
টাঙ্গাইল জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জেলায় মোট ১৫৭টি চালকলের নবায়নকৃত হালনাগাদ তালিকা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে মেজর ক্যাটাগরির চালকল ২টি, অটোমেটিক ৫৭টি এবং সেমি অটোমেটিক বা হাস্কিং বা চাতাল ৯৮টি চালকল রয়েছে। খাদ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের দেওয়া চালকলের সংখ্যা ও ক্যাটাগরীর মধ্যে গরমিলের বিষয়ে ব্যাখা দিয়ে জানানো হয়েছে- অধিকাংশ সেমিঅটোমেটিক বা হাস্কিং বা চাতাল চালকল বন্ধ হয়ে গেছে। আবার চাতাল চালকলের মালিকরা কেউ কেউ কারখানা বন্ধ করে ১০-১২ জন একত্র হয়ে অটোমেটিক চালকল স্থাপন করেছেন। এজন্য জেলায় সর্বমোট চালকলের সংখ্যা কমে গিয়েছে। কিন্তু অনেকে জোটবদ্ধ হয়ে অটোমেটিক চালকল স্থাপন করায় অটোমেটিক চালকলের সংখ্যা ইদানিং বাড়ছে।
সরেজমিনে জানা যায়, নতুন নির্মিত মেসার্স এশিয়া মাল্টি এগ্রো ফুড নামক অটোমেটিক চালকলে মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত না মেনে গত ১৩ জুন বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এরআগে চালকলটির বিপরীতে মধ্যম চাপের (এমটি-৩) বিদ্যুৎসংযোগ দেওয়ার জন্য ২৫ এপ্রিল অনুমোদন দেওয়া হয়। অথচ মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য গত ১০ মার্চ বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিটি দপ্তর/অধিদপ্তরে পত্র দেওয়া হয়। মেসার্স এশিয়া মাল্টি এগ্রো ফুড নামক চালকলের ম্যানেজিং পার্টনার নজরুল ইসলাম জানান, এমটি-৩ সংযোগ দেওয়া যাবেনা বা সংযোগ দিতে সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এমন কোনো কথা বিদ্যুৎ বিভাগ তাদেরকে বলেনি।
টাঙ্গাইল বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডেও (বিউবো) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ওবায়দুল ইসলাম জানান, চালকলগুলো শিল্পের আওতায় পড়ে কী-না তা জানতে তিনি বিউবোর উপর মহলে যোগাযোগ করছেন। চালকল চালাতে এসটি লাইনের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ সংযোগের প্রয়োজন হয়। সরকার কর্তৃক ‘ইকোনমিক জোন বা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত শিল্প এলাকা ছাড়া অন্য কোনো স্থানে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হলে বিদ্যুৎ সংযোগ ও গ্যাস সরবরাহ প্রদান না করা বিষয়টি চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। কিন্তু ওই যে পত্রে ‘শিল্প প্রতিষ্ঠান’ বলা হয়েছে- চালকলগুলো শিল্পের আওতায় পড়ে কী-না তা নিশ্চিত হয়ে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।