স্টাফ রিপোর্টার ॥
টাঙ্গাইলে পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করে সরকারি নির্দেশ অমান্য করে জনবসতি ঘেঁষে ফসলি জমিতে গড়ে উঠছে চালকল বা অটোরাইস মিল। পরিবেশ অধিদপ্তরের তদারকি বা তাগিদ না থাকায় চালকলগুলোতে ইটিপি প্ল্যান্ট স্থাপন করা হচ্ছে না। ফলে কারখানার গরম পানি, ছাই ও দূষিত বর্জ্যে আবাদি জমি ও নদীদূষণ হচ্ছে। নতুন কারখানাগুলো ঘনবসতিপূর্ণ ও ফসলি জমি ঘেঁষে স্থাপন করায় জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের বারোটা বাজছে।
টাঙ্গাইল জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের তালিকা মতে, জেলায় তাদের দেওয়া চালকলের লাইসেন্স বা ছাড়পত্র রয়েছে ৬৩টির। এরমধ্যে টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় ৩টি, সখীপুরে ১টি, নাগরপুরে ১টি, কালিহাতীতে সর্বোচ্চ ২৩টি, ঘাটাইলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২২টি, মধুপুরে ৪টি, ধনবাড়ীতে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৫টি, গোপালপুরে ৪টি চালকলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে। এক্ষেত্রে চালকলের ক্যাটাগরী উল্লেখ না করে শুধুমাত্র পরিবেশের ছাড়পত্র দেওয়া চালকলের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া জেলার ভূঞাপুর, মির্জাপুর, বাসাইল ও দেলদুয়ারে চারটি উপজেলায় স্থাপনকৃত জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে লাইসেন্স নবায়নকৃত ১৪টি চালকলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই।
জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্র মতে, জেলায় ৯৮টি সেমিঅটোমেটিক বা হাস্কিং বা চাতাল কারখানা চালু থাকলেও তারা মাত্র চারটির বিপরীতে ছাড়পত্র দিয়েছেন। অন্য ৯৪টি সেমিঅটোমেটিক চালকল পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই নিয়মিত কার্যক্রম চালাচ্ছে। এছাড়া নতুন অটোমেটিক ২-৩টি চালকল ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার চালকল কারখানাগুলোর মধ্যে ১০-১২টি ছাড়া অধিকাংশ পরিবেশের নিয়মনীতি মেনে স্থাপন করা হয়নি। এ কারণে কারখানার গরম পানি, ছাই ও দূষিত বর্জ্যে আবাদি জমি ও নদীদূষণ হচ্ছে। নতুন কারখানাগুলো ঘনবসতিপূর্ণ ও ফসলি জমি ঘেঁষে নির্মাণ করা হচ্ছে। কালিহাতী উপজেলায়ই প্রগতি এগ্রো ফুড, সুরমা এগ্রো ফুড ও চারান গ্রামে অপর একটি চালকল নির্মাণ করা হচ্ছে। কারখানার মালিকরা বিদ্যুৎ সংযোগসহ আনুসঙ্গিক কাগজপত্রের জন্য স্ব স্ব দপ্তরে আবেদনও করেছেন। তাদের আবেদনগুলো অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
কালিহাতী উপজেলার মৎস্যজীবী জয়দেব রাজবংশী, সুকুমার রাজবংশী, সাধন রাজবংশী, রতি রাজবংশী, সুদীপ রাজবংশী, ভজন রাজবংশী, নিরঞ্জন রাজবংশী, শংকর রাজবংশী, ফজল বেপারী, নয়ন বেপারী, আব্দুস সালাম, নজরুল ইসলাম, আজিজুর রহমান, আলহাজ বেপারী, মাছুম আলী, মণ্টু রাজবংশী, অদ্বীত রাজবংশীসহ আরও অনেকেই জানান, কালিহাতী উপজেলায় অটোরাইস মিলগুলো গড়ে ওঠায় এবং মিল বা কারখানার গরম পানি ও অপসারিত বর্জ্য ফটিকজানী নদীতে ফেলার কারণে নদীর জলজপ্রাণি ও মাছ মরে গেছে। এ নদীকে ঘিরেই এক সময় তাদের একটি মৎস্যজীবী সমিতি গড়ে ওঠেছিল। নদীতে মাছ না থাকায় সমিতিটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন নদীতে মাছের দেখা না পেয়ে অধিকাংশ ভিন্ন পেশায় চলে গেছে। যেসব জেলেরা এখনও পেশাকে ধরে রেখেছেন তারা মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন।
কয়েকজন কারখানা মালিক নাম প্রকাশ না করে জানান, মেসার্স সাহা এগ্রো ফুড, সোনার বাংলা, দেশবন্ধু, ফেয়ার, মা অটোমেটিক এগ্রো ফুড, ফরিদ অটোমেটিক ও মেসার্স মেঘনা অটোমেটিক এগ্রো ফুড এ ৭টি অটোরাইস মিলের গরম পানি ও বর্জ্য ফটিকজানী নদীতে পড়ে। অন্যগুলো নিজস্ব ট্যাঙ্কিতে গরম পানি ফেলে ঠান্ডা হওয়ার পর অন্যত্র ফেলে দেওয়া হয়। তবে কোনো চালকল করখানায়ই ‘ইটিপি প্ল্যাণ্ট’ কেউ স্থাপন করেনি। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ইটিপি প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য কোনো নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি।
জেলার কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জানান, চালকলগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চালানোর কথা বলে মালিকপক্ষ ইউপি থেকে অনাপত্তি সনদ নেয়। মিলের উৎপাদন শুরুর পর এলাকাবাসী তাদের কাছে অভিযোগ জানায়। ছাই উড়ে ঘরবাড়ি, গাছপালা ও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, নদীতে মিলের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। পরিবেশ ও খাদ্য অধিদপ্তর চাইলে এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। ওইসব জনপ্রতিনিধিরা জানায়, যত্রতত্র গড়ে ওঠা স্বয়ংক্রিয় চালকলের (অটোরাইস মিল) কোন বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপি প্ল্যান্ট নেই। তাই কারখানার দূষিত বর্জ্য গিয়ে মিশছে ফসলি জমিতে। পাশের নদীর পানিও বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে।
টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক জানান, তিনি টাঙ্গাইলে সম্প্রতি যোগদান করেছেন। জনবসতি ঘেঁষে ফসলি জমিতে চালকল স্থাপনে পরিবেশ অধিদপ্তরের লাইসেন্স পাওয়ার সুযোগ নেই। ইতোপূর্বে যেসব চালকলের লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে সেগুলো পুণরায় যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে। এছাড়া যেগুলোর লাইসেন্স নেই সেগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।