ঐতিহ্যবাহী ও লোকজ খাবার ঝালঝোলের মেন্দা

টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল স্পেশাল ধনবাড়ী লিড নিউজ

সাদ্দাম ইমন ॥
চিরায়ত বাংলার খাদ্যভাণ্ডারে রয়েছে বৈচিত্র্যময় সব খাবার। এসব লোকজ খাবার শুধু রসনাই তৃপ্ত করে না; এর ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে এলাকাবাসী গর্বও বোধ করেন। বহুকাল ধরে সমাদৃত অনেক আঞ্চলিক খাবার আলাদা সংস্কৃতি ও লোকাচারের রীতি বহন করে। যমুনা বিধৌত টাঙ্গাইল জেলায় এমন একটি লোকজ খাবার ঝালঝোলের মেন্দা।
জানা যায়, মেন্দাকে মিল্লি বা পিঠালিও বলা হয়। এক সময়ে মেন্দা কলাপাতায় পরিবেশিত হতো। তেঁতুল বা জলপাইয়ের অম্বল ছিল বাড়তি উপকরণ। কলাপাতা উঠে গেছে। এখন মেন্দা খাওয়া হয় মাটির শানকি বা ওয়ানটাইম প্লেটে। গরু বা খাসির মাংসের সঙ্গে চালের গুঁড়া মিশিয়ে কড়া মসলায় তৈরি হয় যে ‘ছালুন’ সেটির নামই মেন্দা। মেন্দার মূল উপকরণ দেশি গরু, কচি খাসি বা পাঁঠার মাংস, আউশ ধানের চালের মিহি গুঁড়া এবং হরেক রকমের মসলা। পেশাদার বাবুর্চিরা নিজস্ব স্টাইলে রান্না করায় অঞ্চলভেদে মেন্দার রকমফের ঘ্রাণ ও স্বাদ পরিলক্ষিত হয়। অনুষ্ঠানের আগের রাতে উনুনে বসানো হয় সারি সারি তামার ডেকচি। তাতে বেশ সময় নিয়ে রান্না হয় মেন্দা। সাধারণত মাংস সিদ্ধ হয়ে গেলে মিহি চালের গুঁড়ার ক্বাথ ছালুনের মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে ঘন জ্বাল দিতে হয়। পরে এ ছালুনে ফোড়ন দেওয়া হয়। রান্নায় মসলা প্রয়োগের মাত্রায় বৈচিত্র্য আনলে মেন্দার স্বাদও হয় ভিন্ন ধাঁচের। প্রাচীন কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলে ধনপতি সওদাগরের উপাখ্যানে খুলনার রন্ধন অংশে পিঠালি বা মেন্দার কথা রয়েছে। আবার মনসা মঙ্গলে কবি দ্বিজ বংশীদাস ঘৃতের খরজ্বালে পাঠা বা খাসির মাংসে পিঠালি বা মেন্দার কথা বলেছেন। ঝালঝোলে মিল থাকলেও সেই যুগের পিঠালি আর বর্তমান যুগের মেন্দা একই খাবার কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
যমুনা নদীর ভাঙ্গাগড়া তটভূমি টাঙ্গাইল জেলায় ঠিক কখন মেন্দার ছালুন প্রবর্তিত হয় তার নির্ভরযোগ্য কোনো দলিলও মেলেনি। তবে কোনো প্রাচীন জনপদ যে মেন্দার উৎসভূমি, সেটি একবাক্যে সবাই স্বীকার করেন। ধনবাড়ী উপজেলার প্রবীণরা জানান, লোকজ খাবার মেন্দার প্রচলন করেন মুসলিম জোতদার, তালুকদার বা অভিজাত শ্রেণি। মেন্দায় হাজার হাজার মানুষকে জেয়াফত বা দাওয়াত দেওয়া হয়। খরচ হয় বিপুল অর্থ। খাবার হিসেবে অসম্ভব জনপ্রিয় হলেও খরচের কারণে সাধারণের পক্ষে মেন্দার আয়োজন করা কঠিন। কোনো কোনো মেন্দা অনুষ্ঠানে ৩০-৪০ হাজার মানুষও দাওয়াত পায়। মেন্দা শুধু মজাদার খাবারই নয়, এটি উৎসব নির্ভর গণভোজের উপকরণ। আর গণভোজ কেন্দ্রিক এ উৎসব চিরচেনা সংস্কৃতির মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করে। তাই মেন্দা সংস্কৃতি সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের অনুঘটক।
স্থানীয়বাসিন্দা প্রবীণ জাহিদুর রহমান জানান, মেন্দা সংস্কৃতি মানে দলমত নির্বিশেষে বহু মানুষের জেয়াফত বা দাওয়াতে অংশ নেওয়া এবং সারিবদ্ধভাবে হাঁটু গেড়ে বা নবাবী আসনে বসে একসঙ্গে আনন্দভোজ। লোকজ খাবারের তালিকায় প্রথম আসে মেন্দা। সাধারণত বড়খানা, পিরের ওরস, চেহেলাম, তামদারি, মৃত্যুবার্ষিকী, মিলাদ-মাহফিলসহ নানা গণজমায়েতে মেন্দার সঙ্গে সাদা ভাতের আয়োজন হয়। ধনবাড়ী ও মাদারগঞ্জ উপজেলার সুখনগরীর জহির উদ্দীন মেম্বার, চরবওলার বদিউজ্জামান কমিশনার, চাঁদপুরের আমির হোসেন, মেলান্দহ উপজেলার বানিকুঞ্জের আলী আকবর, সরিষাবাড়ীর আমপুরের আব্দুস সামাদ, ধনবাড়ীর মুশুদ্দীর দরাজ আলী এবং গোপালপুরের চাতুটিয়ার ময়নাল হোসেন ৪০-৫০ বছর ধরে মেন্দা রান্না করেন।
ধনবাড়ীর প্রবীণ সেলিম উল্লাহ জানান, পঞ্চাশের দশকে জামালপুর থেকে মেন্দা সংস্কৃতি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বড় খানা ছাড়াও ছোটখাটো দাওয়াত বা সামাজিক অনুষ্ঠানেও মেন্দার আয়োজন হয়। মাদারগঞ্জ ও ধনবাড়ী পৌরশহরে ১৫টি মেন্দার হোটেল রয়েছে। দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষ এসে মেন্দা ভাত খান। ধনবাড়ীর রজনীগন্ধা হোটেলে প্রতিদিন ৫০০-৬০০ মানুষ মেন্দা খেতে আসেন বলে জানান মালিক ইদ্রিস হোসেন।
ধনবাড়ী উপজেলার সাধারণ মানুষ জানান, মেন্দার মতো ঝালঝোলের খাবার নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে খুবই উচ্ছ্বাস দেখা যায়। মেন্দা শুধু একটি বিশেষ খাবার নয়, মেন্দা মানে যমুনা নদীপাড়ের মানুষের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, নিজস্ব শখ ও রুচির প্রতীক।

 

 

 

 

 

 

২৩ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *