হাসান সিকদার ॥
টাঙ্গাইলের যমুনার চরে এক সময় আবাদ হতো ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল। ’৯০ দশকে নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে যায় চরের অধিকাংশ ফসলি জমি। বাঁধ নির্মাণের ফলে যমুনার ভাঙন অনেকটাই কমেছে। দুই বছর আগে আবারো জেগে উঠেছে চর। তবে আবাদি জমি ফিরে পেলেও ধান চাষে ফিরে যাননি চরাঞ্চলের কৃষকরা।
বহুজাতিক টোব্যাকো কোম্পানীর প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে ধান ছেড়ে তামাক চাষে ঝুঁকছে কৃষকরা। ফসলের অধিক দাম আর তামাকজাত কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন সহায়তার কারণে বেড়েই চলেছে তামাকের বিস্তার।
টাঙ্গাইলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার পাঁচটি উপজেলায় এবার ২৩৩ হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে ভুঞাপুরে ১১৫ হেক্টর, কালিহাতীতে ৯০ হেক্টর, নাগরপুরে ৭ হেক্টর, দেলদুয়ারে ৩ হেক্টর ও সদর উপজেলায় ১৮ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ব্যবহারের ফলে মুখে ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি হয়ে ব্রেন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক হওয়ার মতো ঝুঁকি এবং পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও মাটির গুণাগুণের মারাত্মক ক্ষতির কথা জেনেও শুধু অধিক লাভের আশায় তামাক চাষ করছেন কৃষকরা। তামাক চাষে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের ব্যবহার করার কারণে নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরতা। এতে জীব-বৈচিত্র ও পরিবেশের মারাত্বক ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড, জাপান টোব্যাকো কোম্পানী লিমিটেড, আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানী, বেঙ্গল টোব্যাকো কোম্পানি, গ্লোবাল টোব্যাকো কোম্পানি, তারা টোব্যাকো কোম্পানি তাদের নিজস্ব প্রতিনিধির মাধ্যমে জেলার স্থানীয় কৃষকদের তামাক চাষে উৎসাহীত করছেন।
জানা যায়, চাষের আগে ও পরে বিশেষ সহায়তা দিয়ে থাকে এসব বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। তামাক চাষে বীজ ও সার ক্রয়ের জন্য নগদ টাকাসহ নানান উপকরণ সরবরাহ ও নিয়মিত তদারকি করে কোম্পানির প্রতিনিধিরা। এসব সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি দাম ভালো পাওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনেও দিনদিন তামাক চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। একই সঙ্গে বিকল্প ফসল উৎপাদনে খরচ বেশি ও ন্যায্য মূল্যের নিশ্চয়তা না থাকায় তামাক চাষে আগ্রহ বাড়ছে অনেক কৃষকদের। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫, (২০১৩ সালের সংশোধনী) প্রণীত হয়েছে। এই আইনের ধারা ১২-তে তামাক জাতীয় ফসল উৎপাদন ও চাষ নিরুৎসাহিত করিবার লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় নীতিমালা গ্রহণ করতে পারবে বলেও উল্লেখ্য থাকলে সরকারের পক্ষে থেকে মাঠে তেমন কোন তৎপরতা দেখা মিলে না।
সরজমিনে দেখা যায়, জেলার ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী, নলশা, জগৎপুরা, বামনহাটা, চরনিকলা, নিকরাইল, পালিমা, আমুলা, টাঙ্গাইল সদরের কাকুয়া, হুগড়া, কাতুলী, মামুদনগর, চর পৌলী, কালিহাতী উপজেলার সল্লা, দেউপুর, চর হামজানী, কদিম হামজানী, পটল, বেরী পটল, জোকারচর, গোহালিয়াবাড়ী, কুর্শাবেনু, সলিল গোবিন্দপুর, আফজালপুর ধলাটেঙ্গর, দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি, নাগরপুরের পাকুটিয়া, ভাদ্রা, বেকরা, আটাপাড়া, সলিমাবাদ, ধুবুরিয়া, মোকনা, বনগ্রাম, শাহজানী প্রভৃতি অঞ্চলে মাঠজুড়ে তামাক চাষ হচ্ছে। জেলায় সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ হচ্ছে কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলায়। শুধু এ চরাঞ্চলের গ্রামগুলোতেই কয়েক হাজার একর ফসলি জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে বলে জানান স্থানীয় কৃষকরা।
কৃষি বিভাগের উদাসীনতা, তামাক উৎপাদনে কোম্পানির তৎপরতা, বিক্রির নিশ্চয়তা, চাষের জন্য সুদমুক্ত ঋণ, কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন ও পরামর্শ তামাক চাষের প্রধান কারণ। অন্যদিকে অনলাইনের মাধ্যমে লাইসেন্স করার সুযোগ দিয়ে বিড়ি ও সিগারেট কোম্পানি করার সুযোগ দিচ্ছে। লাইসেন্সের সুযোগ না দিয়ে তামাক চাষ থেকে বের হওয়ার জন্য সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। তামাক কোম্পানির অপতৎপরতা বন্ধ না হলে দিনদিন লোভের কারণে কৃষকরা তামাক চাষে আরও বেশি ঝুঁকে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মৈশানন্দলাল গ্রামের রহিম, মিজান, খোকন ও ছবুর চারজনে মিলে ১১০ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছেন। বৃটিশ টোব্যাকো কোম্পানি তাদের জমির প্রক্রিয়াকরণ, সার বীজের জন্য ঋণ দিয়েছেন প্রায় ৩ লাখ টাকা। জিংক, দস্তা, ছত্রাক নাশক, ডিএপি, ফসফেট সার দেওয়ার জন্য আলাদা করে লোন দেওয়া হয়। প্রতি বিঘা জমিতে উৎপাদন খরচ হয় ৩০-৩৫ হাজার টাকা। বিক্রি হয় ৪৫-৫০ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় লাভ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। ১১০ বিঘা জমিতে তাদের সম্ভাব্য লাভ হবে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। যা ওই জমিতে অন্য কোন ফসল চাষ করে এত টাকা লাভ করা সম্ভব নয় বলে জানান তারা।
হুগড়া ইউনিয়নের আজহার আলী বলেন, আমি চার বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছি। কোম্পানি থেকে ১৪ হাজার টাকা ঋণ দিয়েছেন। তবে এবার অনাবৃষ্টির কারণে উৎপাদন ভাল হয়নি। তারপরেও ৬০-৭০ হাজার টাকা লাভ থাকবে আশা করছি। অন্য ফসল চাষ করলে এতো লাভ পাওয়া যায় না। কালিহাতি উপজেলার সলিল গোবিন্দপুর গ্রামের হাসানুল মিয়া বলেন, আমাদের গোবিন্দপুর গ্রামে প্রায় ৩০০ বিঘা জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। আমি নিজেই ১০ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছি। প্রতি কেজি ২০৫ টাকা ধরে, বাজার ভাল থাকলে ৮ হাজার টাকা মণ উপরে দাম পাব। আমার খরচ হয়েছে দুই লক্ষ টাকা সব মিলিয়ে আমি তামাক বিক্রি করবো ১০ লক্ষ টাকা। কোম্পানি গাড়ি দিয়ে এসে মাল নিয়ে যাবে আর সরাসরি ব্যাংকে টাকা পাঠিয়ে দেয়। সব কিছুই করে দেয় কোম্পানির লোকেরা। আরেক চাষি জব্বার মিয়া জানান, আমি দীর্ঘ ৮ বছর ধরে তামাক চাষ করি। তামাক চাষে অন্য ফসলের তুলনায় দ্বিগুণ লাভ হয়। এতে শরীরের ও পরিবেশের ক্ষতি হলেও লাভের অংকটা অনেক বেশি। তাই তামাক চাষ করি। পাতার আকার ও সংরক্ষণের প্রকারভেদে কোম্পানি দাম কমবেশি নির্ধারণ করে। কোম্পানির লোক ছাড়া বাইরের কেউ তামাক কিনে না। বিক্রি করারও সুযোগ নেই। ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির সলিল গোবিন্দপুর, কুর্শাবেণু দায়িত্বপ্রাপ্ত মাঠকর্মী জিয়া বলেন, কত জায়গায় জুড়ে তামাক চাষ হচ্ছে এটা বলতে পারবো না তবে এখানে ছয়টি টোব্যাকো কোম্পানি কাজ করে। টাঙ্গাইলে দায়িত্বে যে স্যার ছিল সে অবসরে চলে গেছে এখন মাঝে মধ্যে মানিকগঞ্জ থেকে স্যার আসেন।
টাঙ্গাইল মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড রির্সোস ম্যানেজমেন্ট (ইসআরএম) বিভাগের অধ্যাপক ড. এএসএম সাইফুল্লাহ জানান, তামাক সেবন যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তেমনি এই ক্ষতিকর দ্রব্য উৎপাদনে আমাদের কৃষি জমি, বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে যা পরিবেশে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যে জমিতে তামাক চাষ করা হয় সেখানকার উপকারী পোকা মাকড়, অনুজীব ক্ষতিগ্রস্থ করে ফলে জমির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। তামাক থেকে উৎপাদিত পণ্য বিড়ি, সিগারেট এর অব্যবহৃত অংশ মাটি, পানি, বায়ুকে দূষিত করছে এর বিষ খাদ্যচক্রে ছড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া তামাক থেকে নিসরিত নিকোটিন ফুসফুসে ক্যান্সারসহ মানব শরীরে নানা রোগের সৃষ্টি করে।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আশেক পারভেজ বলেন, কোম্পানির লোভের ফাঁদে পা দিয়ে অতিরিক্ত লাভের আশায় কৃষকরা তামাক চাষ করছে। জমির উর্বরতা নষ্ট ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি জানিয়ে কৃষকদের মাঝে সচেতনতা বিষয়ক সভা ও তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে উঠান বৈঠক করা হচ্ছে। কৃষিখাতে যে সকল প্রণোদনা রয়েছে সেগুলো কৃষকদের নিয়মিত প্রদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।