
হাসান সিকদার ॥
প্রায় চার দশক রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করেছে টাঙ্গাইলের বহুল আলোচিত ‘খান পরিবারের’ সন্তানরা। এজন্য বিভিন্ন সময় তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কিন্তু তাদের কখনো বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি।
আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার রায় হবে রোববার (২ ফেব্রুয়ারি)। এই মামলায় খান পরিবারের চার সন্তান আসামি। এই প্রথম তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কোন মামলার রায় হতে যাচ্ছে। এ নিয়ে টাঙ্গাইলে রাজনৈকিত অঙ্গনে চলছে নানা আলোচনা।
বহুল আলোচিত এই মামলায় খান পরিবারের চার সন্তান আসামি। এরা হচ্ছেন- টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা, টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি, ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা। এই চার ভাই ছাড়াও ফারুক হত্যা মামলায় আরও ১২ জন আসামি রয়েছে। এদের মধ্যে বিচার চলাকালে দুই আসামি আনিছুর রহমান রাজা ও মোহাম্মদ সমির কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন।
গত (২৬ জানুয়ারি) ফারুক হত্যা মামলার বাদি ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক টাঙ্গাইলের প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে শেষ হয়েছে। বিচারক মাহমুদুল হাসান রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) মামলার দায়ের রায় ঘোষণার তারিখ দিয়েছেন।
খান পরিবারের সন্তানদের উত্থান-
দীর্ঘদিন টাঙ্গাইলের আওয়ামী রাজনীতি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। এর এক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামসুর রহমান খান শাহজাহান। অপর অংশের নেতৃত্ব দিতেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। বিগত ১৯৯০ সালে কাদের সিদ্দিকী ভারত থেকে দেশে ফেরার পর খান ও সিদ্দিকী পরিবারের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। চাচা শামসুর রহমান খানের পক্ষে তার ভাতিজা আমিনুর রহমান খান বাপ্পি, আমানুর রহমান খান রানা এবং সহিদুর রহমান খান মুক্তি একটি বাহিনী গড়ে তুলেন। তাঁরা শহরের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ সময় তাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়। এজন্য কারাগারেও যেতে হয়েছে বহুবার। বিগত ২০০৩ সালের নভেম্বরে সন্ত্রাসী হামলায় খান পরিবারের রড় সন্তান আমিনুর রহমান খান বাপ্পি নিহত হন। বাপ্পি নিহত হওয়ার পর তাদের অপর দুইভাই জাহিদুর রহমান খান কাকন ও সানিয়াত খান বাপ্পা এসে যুক্ত হন ভাইদের বাহিনীতে।
বিগত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর খান পরিবারের সন্তানদের প্রভাব আরও বেড়ে যায়। বিগত ২০১২ সালে খান পরিবারের ছেলে রানা টাঙ্গাইল-৩ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে বিগত ২০১১ সালে তার ভাই সহিদুর রহমান খান মুক্তি টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। অপর ভাই কাকন বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্ব নেন। ছোট ভাই বাপ্পা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হন। পুরো জেলার ব্যবসা বাণিজ্য, রাজনীতি ঠিকাদারী তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
মামলা হলেও বিচার হয়নি-
এই চার ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় হত্যা, চাঁদাবাজি, দখল, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিভিন্ন সময় মামলা হয়েছে। রানার বিরুদ্ধে অন্তত পাঁচটি হত্যা মামলাসহ অর্ধশতাধিক মামলা হয়েছে। মুক্তির বিরুদ্ধেও পাঁচটি হত্যাসহ মামলা হয়েছে প্রায় ৪০টি। কাকনের বিরুদ্ধে তিনটি হত্যাসহ এবং বাপ্পার বিরুদ্ধে চারটি হত্যাসহ ডজন খানেক মামলা হয়েছে। এতো মামলা হলেও তাদের কখনো বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। কখনও তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার হয়েছে। কখনও বাদি পক্ষকে চাপ দিয়ে মামলা তুলে নিতে বাধ্য করেছেন। আবার কখনও ভয়ে কেউ স্বাক্ষী দিতে যায়নি। ফলে তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কোন মামলার বিচার হয়নি এর আগে।
এই প্রথম বিচারের মুখোমুখি-
বিগত ২০১৩ সালের (১৮ জানুয়ারি) টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদের গুলিবিদ্ধ লাশ তাঁর শহরের কলেজ পাড়া এলাকার বাসার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। ঘটনার তিন দিন পর তাঁর স্ত্রী নাহার আহমেদ বাদী হয়ে টাঙ্গাইল সদর থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন। বিগত ২০১৪ সালের আগস্টে এই হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আনিসুল ইসলাম রাজা ও মোহাম্মদ আলী নামক দুইজনকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁরা আদালতে জবানবন্দি দেন। তাঁদের জবানবন্দিতে আওয়ামী দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা, তাঁর ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার তৎকালীন মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি, ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পার নাম বের হয়ে আসে। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওয়াহেদ, আবদুল খালেক ও সনি আদালতে জবানবন্দি দেন। তাঁদের জবানবন্দিতেও হত্যার বর্ণনা উঠে আসে। এরপর চার ভাই আত্মগোপনে চলে যান। রানা আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তিন বছর হাজতে থাকার পর জামিন লাভ করেন। গত বছরের (৫ আগস্টের) পর রানা আবার আত্মগোপনে চলে যান। অপর দুই ভাই বিগত ২০১৪ সাল থেকে বিদেশে অবস্থান করছেন বলে তাদের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন। গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম মাহফীজুর রহমান বিগত ২০১৬ সালের (৩ ফেব্রুয়ারি) রানার অপর তিন ভাইসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। বিগত ২০১৭ সালের (৬ সেপ্টেম্বর) আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। গত (২৬ জানুয়ারি) মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেন, ফারুক হত্যা মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে আগামী দিনের টাঙ্গাইলের আওয়ামী রাজনীতির গতিপথ অনেকটা নির্ধারিত হবে। খান পরিবারের সন্তানদের সাজা হলে রাজনীতিতে তাঁদের আর অবস্থান থাকবে না। সাজা না হলে ভবিষ্যতে তাঁরা আবার দলের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবেন।
নিহত ফারুক আহমেদের ছেলে আহমেদ মজিদ সুমন জানান, মামলা থেকে তদন্ত, আদালতে অভিযোগ গঠন, সাক্ষী গ্রহণ বিভিন্ন পর্যায়ে আসামিরা বিচার প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। আইন সঠিক পথে চললে আসামিদের শাস্তি হবে বলে আশা করছি।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁশুলি মোহাম্মদ সাইদুর রহমান স্বপন জানান, যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে ২৭ জন স্বাক্ষীর জবানবন্দি, জেরা, কয়েকজন আসামী ও স্বাক্ষীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনা করে আদালতকে শোনানো হয়েছে। আমরা যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণে সক্ষম হয়েছি যে আসামীরা দোষী। আসামীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে বলে আশা করি।