
মোজাম্মেল হক ॥
চাষের জন্য নিজের কোন জমি না থাকলেও কৃষক বাবলু দেওয়ান। কিন্তু থেমে যাওয়ার মানুষ নয়, দাদা ইসমাইল দেওয়ানের কাছ থেকে পৈত্রিক সূত্রে বাবা ফজল দেওয়ান ও বাবলু দেওয়ান কিছু না পেলেও চেষ্টার কমতি ছিল না। কৃষিজমি না থাকায় বাবলু দেওয়ান মানুষের দ্বারে দ্বারে কৃষি জমি লিজ/কট নেয়ার জন্য ঘুরেন। ছোট ছোট জমি চাষাবাদের পর একসময় খাঁটি কৃষক হয়ে যান বাবলু দেওয়ান। এখন তিনি সফল একজন কৃষক। কৃষির সফলতায় তার ৩ ছেলে, ১ মেয়ে ও স্ত্রী জাহানারা বেগমের সংসার চলছে সুখ-শান্তিতে।
চেষ্টা করলে মানুষ সফলতা অর্জন করতে পারে। এমনই একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার গয়হাটা ইউনিয়নের আগত গয়হাটা গ্রামের বাবলু দেওয়ান। বাবলু দেওয়ানের নিজের কোন জমি না। অন্যের জমি লিজ এবং জমি বন্ধক নিয়ে কৃষিকাজ করা বাবলু দেওয়ানের ব্যাংকে কোন লেনদেন নাই। নিজের জমানো অর্থ দিয়েই ফজল দেওয়ানের পুত্র বাবলু দেওয়ান অন্যের জমি কট বা লীজ ও বন্ধক নিয়ে চাষাবাদ করেন। তাকে সহযোগিতা করেন তার ৩ পরিশ্রমী সন্তান জাহিদ দেওয়ান, জাকির দেওয়ান ও সজিব দেওয়ান। থাকার মতো আছে ২৪ শতাংশের বসতবাড়ী।
পূর্বপুরুষ দাদা ইসমাইল দেওয়ানের উত্তরসুরী হিসেবে বাবার মতো বাবলু দেওয়ানও তেমন জমিজমা পাননি। তবে জীবনযুদ্ধে হার না মেনে অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করছেন প্রায় ২৬ বছর। শুরুতে বীজের ব্যবসা করতেন। বীজের ব্যবসায় ভালো কিছু দেখতে না পেয়ে শুরু করেন চাষবাদ। শুরু থেকে আখ চাষে মনোযোগী হন। যা এখন পর্যন্ত চলমান আছে। তবে পরিমানে কম। ১৪০ শতাংশ জমিতে আখ ছাড়াও সবজি চাষ করেন। ৯৯ শতাংশ বা ৩ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেন। প্রায় ১১ মাস অন্তর আখের ফলন পাওয়া যায়। কার্তিক মাসে বপন করে অগ্রহায়ন মাসে গুড় তৈরীর জন্য উপযুক্ত হয়। শুরুতে চিবানো আখও চাষ করতেন। পরে গুড় তৈরী করতে পিয়াসী আখ চাষ শুরু করেন, যা এখনও চলমান আছে। এবার আখ চাষে ১ লক্ষ টাকা খরচ করেছেন। প্রায় ৬০ মন গুড় ঘরে উঠবে বলে আশাবাদী।
এলাকাবাসী এবং দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এই গুড় কিনে নিয়ে যায়, যে কারণে পাইকারী বিক্রির ঝামেলায় যেতে হয় না। এ বছর খরচ বাদ দিয়ে আড়াই লক্ষ টাকার মতো লাভ থাকবে। এছাড়া সারাবছরই বিভিন্ন মৌসুমের শাকসবজি চাষ করছেন। এ কাজে তাকে মেঝ ছেলে জাকির দেওয়ান দায়িত্ব নিয়ে দেখাশুনা করছেন। জাহিদ ও সজিব দেওয়ান ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করার পাশাপাশি তারাও বাবার কাজে সহায়তা করেন। তবে সবজি চাষে জাকির দেওয়ান একাই পরিশ্রম করেন। ৫ম শ্রেনী পাশ করা জাকির দেওয়ান জানান ছোট বেলা থেকে প্রায় ২০ বছর ধরে কৃষি কাজ করছে। বাবা বাবলু দেওয়ানের পরামর্শ নিয়ে সারাবছর বিভিন্ন মৌসুমের শাকসবজি চাষ করেন। টমোটো, আলু, পটল, লাউ, কুমড়া, মরিচ, বেগুন, লতি, ক্ষিরা, শশা, ফুল কপি, বাঁধাকপিসহ সবজি চাষ করেন। টিএস, বাহুবলি টমেটো চাষ সর্ম্পকে বলেন, এবার ৬০ হাজার টাকা খরচ করে ২৫ শতাংশ জমিতে টমেটোর চাষ করেছেন। ফলন পেতে দুই মাস সময় লেগেছে। তিনি আশাবাদী ১ লক্ষ থেকে দেড় লক্ষ টাকা লাভ করবেন বলে আশা করছেন। এছাড়া অন্যান্য সবজি লাগানো শুরু করছেন। এই মুহুর্তে মরিচ গাছ তুলে লতি ও পটল লাগানো শুরু করছেন। তিনি কীটনাশক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করেন। কারণ জৈব সার ব্যবহার করার ফলে তার মতে সবজির আসল স্বাদ পাওয়া যায়।
আগত গয়হাটা গ্রামের আজাহার আলী, জুলহাস মিয়া, রাজীব খান, আমেনা বেগম, আওয়াল মিয়া সাথে কথা বলে জানা গেছে, কৃষক বাবলু দেওয়ান একজন খাঁটি কৃষক। তার পরিবারের সবাই কৃষিকাজে পরিশ্রম করেন। এজন্য কৃষি কাজে সফলতা অর্জন করেছেন।
এ বিষয়ে নাগরপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা রাশেদুল হাসান বলেন, নাগরপুরে ৭০ হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়। এর মধ্যে ফিফটি চিবানো এবং বাকী অংশ রস বানিয়ে গুড় বানানো হয়। এই গুড় উন্নতমানের গড়। যা বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এছাড়া নাগরপুরে উচ্চ মূল্যেও ফসল আলু, পটল, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করা হয়। সরকারি সহায়তায় কৃষকদের সহযোগিতা করতে আমার পাশে আছি।
কৃষির সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের কৃষকের প্রাণ। কৃষির উন্নতি না হলে কৃষকের উন্নতি হবে না। কৃষির উন্নতি যদি বাধাগ্রস্থ হয় তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাই কৃষির উন্নতি সাধিত হলে কৃষকেরও দূদর্শা লাঘব হবে। এ ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যে চেতনাবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। পুরানো আমলের চাষাবাদ প্রণালী পরিবর্তন করে আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত চাষাবাদে মনোযোগী হতে হবে। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা সর্ম্পকে কৃষকদের কৃষি বিশেষজ্ঞ ও কৃষি কর্মকর্তাদের সক্রিয় সহযোগিতা তাদের এ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে।
এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ালে কৃষক বাবলু দেওয়ানের মতো কৃষকরা আরো বেশী আখ কিংবা সবজি চাষ করতে পারবে। এতে কৃষকের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধশালী হবে।