আদালত সংবাদদাতা ॥
রাজশাহীগামী চলন্ত বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানীর ঘটনায় জড়িত ডাকাত দলের সদস্যরা সবাই নেশাগ্রস্থ। বাস থেকে লুন্ঠনকৃত একটি মুঠোফোন সেটের বিনিময়ে গাঁজা কিনে সেবন করে। আর ওই গাঁজা বিক্রেতার সূত্র ধরেই সন্ধান মেলে ডাকাত চক্রের সদস্যদের। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনায় জড়িতরা সবাই অতিমাত্রায় মাদকাসক্ত। নেশার টাকা সংগ্রহের জন্যই তারা সাভার আশুলিয়া এলাকায় বাস ডাকাতিসহ ছিনতাই ও নানা অপকর্ম করে থাকে। মামলার তদন্ত ও অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের সাথে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।
গত সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দিনগত রাতে ইউনিক রোড রয়েলসের আমরি ট্রাভেলস নামক বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। রাত ১১টায় ঢাকার গাবতলী থেকে ৩০/৩৫ জন যাত্রী নিয়ে বাসটি রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে যাত্রীবেশী ৮/৯ জন ডাকাত অস্ত্রের মুখে বাসটি নিয়ন্ত্রণে নেয়। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে বাসটিকে বিভিন্ন স্থান ঘুরিয়ে যাত্রীদের টাকাপয়সা, মালামাল লুন্ঠন করে। এ সময় তারা নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানিও করে। ঘটনার তিনদিন পর বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাতে মির্জাপুর থানায় ওমর আলী নামে এক যাত্রী বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেন।
মামলা দায়েরের পর টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ও মির্জাপুর থানা পুলিশের সমন্বয়ে একটি বিশেষ টিম গঠন করে দেন। ওই দিনই টিমের সদস্যরা ডাকাতদের সন্ধানে মাঠে নামে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) উপপরিদর্শক (এসআই) আহসানুজ্জামান জানান, তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে বুঝতে পারেন ডাকাত দলের সদস্যরা সাভার আশুলিয়া এলাকার। তখন তিনি তার একজন তথ্যদাতার (সোর্স) মাধ্যমে জানতে পারেন ওই এলাকার নেশাখোর কিছু যুবক বাস ডাকাতিসহ নিয়মিত চুরি, ছিনতাই করে থাকে। তারা সাভার এলাকার একজন মাদক কারবারির কাছ থেকে নিয়মিত গাঁজা, হেরোইন ক্রয় করে। সোর্সের তথ্য অনুযায়ি শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে সাভারের চন্দ্রা-নবীনগর সড়কের একটি পেট্টোল পাম্পের সামনে থেকে ওই মাদক কারবারিকে আটক করে। ২২/২৩ বছর বয়সী ওই মাদক কারবারি পুলিশকে জানায়, কিছু দিন আগে একটি মুঠোফোন সেটের বিনিময়ে তার কাছ থেকে শহিদুল, সবুজ ও শরীফুজ্জামানসহ কয়েকজন গাঁজা নিয়ে গেছে। তখন ওই মাদক কারবারিকে সাথে নিয়ে পুলিশ শহিদুলদের সন্ধানে বের হয়। ওই মাদক কারবারির সাথে পুলিশ সাভারের গেন্ডা এলাকা যায়। বিকেল ৫টার দিকে সেখানে অটোমোবাইল গ্যারেজে থাকা একটি বাসে ঘুমাচ্ছিল মোঃ সবুজ ও শরীফুজ্জামান। গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা বাসটিতে ঢুকেই তাদের হাতকড়া পড়িয়ে ফেলেন। তারা নেশায় এতটাই বুঁদ হয়েছিল যে হাতকড়া পড়ানোর পরও বুঝতে পারেনি। পুলিশ তাদের ডেকে তুলে। বাসের ভেতরেই ডাকাতির বিষয়ে প্রশ্ন করা শুরু করে। পুলিশ যখন দুইজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল সেই সময় বাসটির কাছে আসে ডাকাত দলের অপর সদস্য শহিদুল ইসলাম। তাকেও ধরে ফেলা হয়। শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) গভীর রাতে তাদের টাঙ্গাইল নিয়ে আসা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সবাই ডাকাতির সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।
গ্রেপ্তারকৃত শহিদুল ইসলাম ওরফে মহিদুল ওরফে মুহিত মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার লাউতারা গ্রামের বদর উদ্দিন শেখের ছেলে। মোঃ সবুজ শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের ইসমাইল মোল্লার ছেলে। এবং অপর আসামী শরীফুজ্জামান শরীফ সাভারের টানগেন্ডা এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে।
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারকৃত শহিদুল ইসলামের নামে দুইটি বাস ডাকাতি ও তিনটি মাদক মামলা রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, নেশার টাকার জন্যই তারা ডাকাতি, ছিনতাই করে থাকে। এসব কর্ম করে যে টাকা পায় তা দিয়েই নেশা করে। টাকা শেষ হয়ে গেলে আবার ডাকাতি, ছিনতাই শুরু করে। শহিদুলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।
গ্রেপ্তারকৃত মোঃ সবুজ ও শরীফুজ্জামান শরীফ টাঙ্গাইলের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্টেট আদালতে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে ঘটনার সাথে জড়িত আরও ৩ জনের নাম-ঠিকানা তারা জানিয়েছেন বলে আদালত সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে মামলার বাদি বাসের যাত্রী ওমর আলী শনিবার টাঙ্গাইল গোয়েন্দা কার্যালয়ে গিয়ে গ্রেপ্তারকৃতদের সনাক্ত করেন। তিনি জানান, গ্রেপ্তারকৃত ৩ জনই ডাকাতিতে অংশ নিয়েছে। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে যে টাকা উদ্ধার করা হয়েছে, তা তার (ওমর আলীর) কাছ থেকেই ছিনিয়ে নিয়েছে বলে তিনি জানান।
টাঙ্গাইল জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মোশারফ হোসেন জানান, ডাকাতির সাথে বাসটির চালক ও তার সহকারিদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।
তদন্তকারী কর্মকর্তা আহসানুজ্জামান বলেন, বাস ডাকাতির সময় নারী যাত্রীদের ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। তবে নারী যাত্রীরা শ্লীলতাহানীর শিকার হয়েছেন। তিনি জানান, এই ঘটনার সাথে জড়িত অন্য যাদের সনাক্ত করা গেছে তাদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।