স্টাফ রিপোর্টার ॥
নিরবে কাঁদছে কৃষক। শুরু থেকেই সবজির দাম নেই। খেতেই পঁচে নষ্ট হচ্ছে সবজি। কৃষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ। অন্যের পুষ্টির চাহিদা মিটলেও বিক্রির টাকায় দুইবেলা দুমুঠো ডালভাত জুটছে না। উল্টো ঘাড়ে চেপেছে ঋণের বোঝা। মানুষের থেকে সুদে আনা টাকা, ব্যবসায়ীর দেওয়া দাদন, সার ও কীটনাশকের দোকান বাকী এবং এনজিও’র কিস্তির চাপে দেউলিয়া হওয়ার পথে হাজারো কৃষক। এ যেন আধাঁর দূর করতে অন্ধকারের পথে তারা। ভাবাচ্ছে চাষিদের। চাষে ভাটা পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমন চিত্র টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার। কৃষকদের অভিযাগ খোঁজ নেওয়া তো দূরের কথা কৃষি অফিসের কাউকে তারা চিনেন না।
জানা গেছে, স্থানীয় হাট এবং বাজারের জায়গা সংকটের কথা বিবেচনা করে ফুলকপি ও বাঁধাকপি নিয়ে আসায় এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে ঘাটাইল উপজেলার গারোবাজার ও সাগরদীঘি বাজারে গিয়ে সিম এবং বেগুনের দেখা মেলে। পাইকারী প্রতি মণ সিম ১৫০ এবং বেগুন বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। অর্থাৎ সিমের কেজি পৌঁনে চার টাকা এবং বেগুন পাঁচ টাকা। অথচ ক্ষেত থেকে সবজি তুলতে কেজি প্রতি শ্রমিক খরচ দাঁড়ায় পাঁচ টাকা।
ঘাটাইল উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, চলতি বছর সবজির আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে। মাটি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন হয়েছে বেশ ভালো। সবচেয়ে বেশি সবজির চাষ হয়েছে সাগরদীঘি ও লক্ষ্মীন্দর ইউনিয়নে। স্থানীয় কৃষকদের দেওয়া তথ্যমতে দুই ইউনিয়নে সবজি চাষের সঙ্গে জড়িত কৃষকের সংখ্যা এক হাজারের উপরে। পাহাড়ী এলাকা হওয়ায় বছর জুড়েই চলে সবজির আবাদ। অধিকাংশ কৃষকের নেই নিজস্ব জমি। লিজ নিয়ে অন্যের জমিতে ফলান সবজি। হাত ঘুরে এই সবজি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। ধার-দেনা আর কষ্টে ফলানো এই ফসলই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষকের জন্য। লাভ তা দূরে থাক সবজি চাষ করে খরচের অর্ধেক টাকা ঘরে তুলছেন এমন একজন কৃষকও পাওয়া যাবে না বলে জানান কৃষক নাসির উদ্দিন সিকদার। একজন শ্রমিক সারাদিন কাজ করে ক্ষেত থেকে সর্বোচ্চ দুই মন সবজি তুলতে পারেন। মজুরি হিসেবে দিতে হয় চারশ টাকা। আর দুইমন সবজি সিম বা বেগুনে ভ্যান ভাড়া দিয়ে বাজারে নিয়ে বিক্রি করে কৃষক পান তিনশ টাকা। তার ভাষ্য, ঋণের চাপে অল্প কিছুদিনের মধ্যে অনেক কৃষক ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবেন।
উপজেলার মনতলা গ্রামের কৃষক হেলাল উদ্দিন বলেন, জমি লিজ নিয়ে সাড়ে তিন বিঘা জমিতে সিমের আবাদ দিয়েছিলাম। খরচ সাত লাখ টাকা। বিক্রি হয়েছে মাত্র ৬০ হাজার টাকা। কিছু টাকা নিজের ছিল আর বাকী টাকা এনজিও এবং মানুষের থেকে সুদে ঋণ করে আনা। কৃষি অফিস থেকে সবজি চাষে উৎসাহ দিলেও এখন খোঁজ নেন না। বর্তমান এনজিওর কিস্তি চালাচ্ছেন অন্যের থেকে সুদে টাকা এনে। একই গ্রামের কৃষক ফয়েজ উদ্দিন বলেন, আমি ২৭ বিঘা জমিতে সিম এবং সাড়ে ৮ বিঘায় বেগুন আবাদ করেছি। জমি লিজের টাকা এবং চাষের খরচ যোগাতে ব্যাংক ঋণ, মাসিক চড়া সুদে মানুষের থেকে এনেছি টাকা। চার লাখ টাকা বাকী রয়েছে সার ও কীটনাশকের দোকানে। তবে দোকানদারের চাপে সুদে টাকা এনে দুই লাখ শোধ করেছি। তার অভিযোগ সরকারিভাবে কৃষি প্রণোদনা থেকে শুরু করে কোনো প্রকার সুযোগ-সুবিধা তাদের ভাগ্যে জোটেনা।
কৃষক আনিছ মিয়া বলেন, শতশত মণ সিম খেতে নষ্ট হচ্ছে। যেখানে ৩ লাখ টাকার মতো সিম বিক্রি করার কথা সেখানে পাঁচ হাজার টাকাও পাই নাই। এটাকে ক্ষতি বলে না এটাকে বলে ধ্বংস। ভ্যান চালক জসিম উদ্দিন বলেন, এহন আর সিমুর এবং বেগুনের ক্ষ্যাপ বাইনা। কৃষক এবং পাইকাররা ভাড়া দিবার চায়না। দিলেও কম দেয়। এদিকে পাইকাররা এখন আর সবজি নিচ্ছেন না। অনেকেই এ ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে এরই মধ্যে অনেকেই ছেড়েছেন ঘর-বাড়ি। ঋণের চাপে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন আনোয়ার হোসন নামে এক ব্যবসায়ী। সাগরদীঘি বাজারের সারের খুচরা ডিলার ও কীটনাশকের ডিলার আজহারুল ইসলাম জানান, ১৫০ জন সবজি চাষির কাছে সার ও কীটনাশক বাকীতে বিক্রি করেছেন। টাকার পরিমাণ ছিল ২৮ লাখ। কিছু টাকা পেলেও এখনো বাকী অনেক। কেউ টাকা দিতে স্বীকার হয় না। কৃষকের হাতে টাকা নাই।
এ বিষয়ে ঘাটাইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দিলশাদ জাহান বলেন, তুলনামূলকভাব গত বছরের চেয়ে সবজির দাম একটু কম। সব সবজি চাষিরা এবার ক্ষতিগ্রস্ত। উৎপাদনের দায়িত্ব আমাদের, পলিসি ম্যানেজটা তা আমাদের না। কৃষকের অভিযোগ কৃষি প্রণোদনা থেকে শুরু করে কোনো প্রকার সাহায্য সহযোগিতা না পাওয়ার বিষয়ে বলেন, কৃষকের ধরণ দেখতে হবে। ইতিপূর্বে প্রণোদনা পেয়েছে কিনা তা দেখতে হবে। আর ঘুরে ফিরে কাউকে না কাউকে তো দেওয়া হয়। তবে এটা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন। কৃষি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অফিসের কাউকে কৃষকরা চিনেন না বিষয়ে তিনি বলেন, একটি কৃষি ব্লক খুব একটা বড় না। একজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সব কৃষককে চিনবেন এটা স্বাভাবিক। যদি এমনটা হয় আর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় তবে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।