৪১৫ বছরের আতিয়া জামে মসজিদ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে

টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল স্পেশাল দেলদুয়ার লিড নিউজ

সাদ্দাম ইমন ॥
বাংলাদেশে সুলতানি এবং মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত যেসব স্থাপত্য রয়েছে, তার মধ্যে টাঙ্গাইলের আতিয়া জামে মসজিদ অন্যতম। এই মুসলিম স্থাপত্যটি প্রায় ৪১৫ বছর আগে নির্মিত হলেও মসজিদটির কারুকাজ এখনো সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মসজিদটি দেখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন। সব মিলিয়ে আতিয়া মসজিদ যুগসন্ধিলগ্নের স্থাপত্য ও নিদর্শনরূপে পরিচিত।
জানা যায়, মসজিদটির ভেতরে পাঁচটি কাতারের প্রতিটিতে ১৮ জন করে ৯০ জন এবং মসজিদের বারান্দায় ৩৬ জন মুসুল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। এছাড়া মসজিদের বাইরে আরও প্রায় ৫০০ জনের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। টাঙ্গাইল শহর থেকে দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ-পশ্চিমে আট কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক আতিয়া মসজিদটির অবস্থান। ১৯৭৮ সালে ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদে প্রথম আতিয়া মসজিদটি স্থান পায়। এরপর ১৯৮২ সালে পরিবর্তিত ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদেও স্থান পায় আতিয়া মসজিদ। এতে দেশবাসীর কাছে সহজেই মসজিদটি পরিচিতি লাভ করে। তবে আজকাল দশ টাকার পুরাতন নোটটি তেমন দেখা যায় না। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৭৮ সালে মসজিদটির দেখভালের দায়িত্ব নেয়।

ঐতিহাসিক আতিয়া জামে মসজিদের প্রতিকৃতি ১০ টাকার নোটে পুনঃ স্থাপনের দাবিতে অতিসম্প্রতি টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং বিভিন্নস্তরের নাগরিকবৃন্দ। তারা টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এ বিষয়ে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। এ সময় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা অংশ নেন। জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষে স্মারকলিপি প্রদান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন কো-অর্ডিনেটর মাসুদুর রহমান রাসেল এবং টাঙ্গাইল সদর উপজেলার আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট কামরুজ্জামান শাওন। এছাড়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করেন আবু আহমেদ শেরশাহ, ফাতেমা রহমান বীথি, মুনসুর হেলাল, রাকিবুল হাসান রাজু, সুমাইয়া আক্তার ইতি, রুমি, মাকসুদ, হাবিব, সুজন, নিলয়, তাওহীদ, আসিফুর রহমান, অমিত, সামিয়া, তৃপ্তি, তাহিমসহ আরও অনেকেই।
স্মারকলিপিতে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর গুরুত্ব তুলে ধরে দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি অপরাধ দমনেও প্রশাসনকে কার্যকর ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানানো হয়। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। আতিয়া জামে মসজিদের প্রতিকৃতি ১৯৯৬-১৯৯৭ সালে মুদ্রিত ১০ টাকার নোটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে নোটের ডিজাইনে পরিবর্তন আনা হলে এই প্রতিকৃতি সরিয়ে ফেলে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার।
জানা গেছে, পঞ্চদশ শতকে এই অঞ্চলে আদম শাহ বাবা কাশ্মীরি নামের এক সুফি ধর্মপ্রচারক আসেন। ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। এই পুণ্যবান ব্যক্তির কবর এখানেই অবস্থিত। শাহ কাশ্মিরীর অনুরোধে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর সাঈদ খান পন্নীকে আতিয়া পরগণার শাসক নিয়োগ করা হয়। সাঈদ খান পন্নীই করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন। ‘আতিয়া’ শব্দটি আরবি ‘আতা’ শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ হলো ‘দান’। ওই সময় ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনার ব্যয়ভার বহনের জন্য কররানি শাসক সোলাইমান কররানির কাছ থেকে বিশাল একটি এলাকা ‘ওয়াকফ’ হিসেবে পান। সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্য শিল্পরীতির সমন্বয়ে নির্মিত এ মসজিদের পরিকল্পনা ও নির্মাণকাজে নিযুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ। নির্মাণের পর ১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরী ও ১৯০৯ সালে আবুল আহমেদ খান গজনবি মসজিদটি সংস্কার করেন বলে জানা যায়।
প্রাচীন এই মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ১৮.২৯ মিটার ও প্রস্থে ১২.১৯ মিটার। মসজিদের দেওয়ালের পুরুত্ব ২.২৩ মিটার ও উচ্চতা ৪৪ ফুট। মসজিদের চারকোণে চারটি অষ্টকোণাকৃতির মিনার রয়েছে। মসজিদটির প্রধান কক্ষ ও বারান্দা দুই ভাগে বিভক্ত। মসজিদের পূর্ব ও মাঝের দেওয়ালে রয়েছে একটি করে দরজা। বারান্দাসহ উত্তর-দক্ষিণ দেওয়ালে রয়েছে দুটি করে দরজা। ভেতরের পশ্চিম দেওয়ালে আছে তিনটি সুন্দর মিহরাব। প্রধান কক্ষের প্রত্যেক দেওয়ালের সঙ্গে দুইটি করে পাথরের তৈরি স্তম্ভ রয়েছে। প্রধান কক্ষের উপরে রয়েছে একটি বিশাল মনোমুগ্ধকর গম্বুজ। বারান্দার পূর্ব দেওয়ালে রয়েছে তিনটি প্রবেশপথ। মাঝখানের প্রবেশপথের উপরের অংশের নিম্নভাগে একটি শিলালিপি রয়েছে। বর্তমানে যে শিলালিপিটি রয়েছে এর আগেও সেখানে একটি শিলালিপি ছিল বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। এই শিলালিপিটি ফার্সিতে লেখা। কোনো কারণে আদি শিলালিপিটি বিনষ্ট হলে পরবর্তীকালে মসজিদ মেরামতের সময় বর্তমান শিলালিপিটি লাগানো হয়। মসজিদটি টেরাকোটার ইটের তৈরি। চুন, সুরকি গাঁথুনি দিয়ে মসজিদটি নির্মিত। সুলতানি আমলে প্লাস্টার পদ্ধতি ছিল না। তাই তারা চুন ও সুরকির গাঁথুনি দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করত।
আতিয়া মসজিদের নাম একবার হলেও শোনেনি এমন ব্যক্তি হয়তো খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। শত বছরের প্রাচীন মসজিদটি চালুর পর থেকে রোজ নামাজ আদায় চলছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা জানান, মসজিদটি শুধু ঐতিহ্যের নিদর্শনই নয়, একটি দর্শনীয় স্থানও। কারিগররা মন্ত্রমুগ্ধকর কাজ করেছেন। এটি ধরে রাখা দরকার। নামাজ পড়তে আসা মুসল্লি কামাল হোসেন বলেন, মসজিদটিতে বেশি মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে না। মসজিদের বাইরে নামাজ পড়তে হয়। উদ্যোগ নেওয়া দরকার যাতে বেশিসংখ্যক মুসুল্লি এখানে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদ কমিটির সদস্যরা জানান, সুলতানি ও মোঘল আমলের স্থাপত্যটি দেখতে প্রতিনিয়ত দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীরা আসেন। তবে মসজিদটির সংস্কার প্রয়োজন। সম্প্রতি যা সংস্কার করা হয়েছে তা বেশিদিন টেকসই হবে না। এখানে রমজান মাস ও শুক্রবারে বেশি দর্শনার্থী আসেন।

আতিয়া জামে মসজিদ পরিচালনা পরিষদের দপ্তর সম্পাদক আইনজীবী ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটিতে নানা সমস্যা বিরাজ করছে। মসজিদের সামনের বিশাল পুকুরের চারপাশে পাড় ভেঙে গেছে। মসজিদে প্রবেশের জন্য পুকুর পাড় ভেঙে যাওয়ায় মুসুল্লিদের যাতায়াতে অসুবিধা হচ্ছে। পুকুরের পাড় স্থায়ীভাবে বাঁধাই করা প্রয়োজন। মসজিদের পূর্বপাশে যে ফ্লোর রয়েছে, সেই ফ্লোর অসমতার কারণে মুসুল্লিদের সেজদা দেয়ার সময় কপাল ও হাঁটুতে ব্যাথা লাগে। দীর্ঘদিন আগে মসজিদের ছাদে বজ্রপাতের ফলে একটি ফাটল তৈরি হয়েছে। অতিবৃষ্টির সময় সেই ফাটল দিয়ে বৃষ্টির পানি চুয়ে মসজিদের ভেতর প্রবেশ করে। মূল ভবনের দেয়াল থেকে শুরু করে বারান্দার গম্বুজ পর্যন্ত শেওলা পড়ে স্যাতসেতে হয়ে যাচ্ছে। মসজিদের সীমানার ভেতর একটি কূপ রয়েছে। ময়লা আবর্জনা পড়ে কূপটি ব্যবহারের অনোপযোগী হয়ে পড়েছে। কূপটি সংস্কার করে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা প্রয়োজন। মসজিদের কারুকাজগুলো লোনা ধরে খসে পড়ছে। মসজিদের উত্তর পাশে নকশা ও কারুকাজ সংস্কারের সময় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বেশির ভাগ অংশ সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে আটকে দিয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বড় ধরনের সংস্কারের মাধ্যমে মসজিদের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনবে, এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয় বাসিন্দাদের।
মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান ইমরান বলেন, ভেতরে শতাধিক মুসুল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকার কারণে জুমার দিন বেশি সমস্যা হয়। মসজিদ কমিটিসহ এলাকার সকলে মিলে জায়গা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদের নকশা নষ্ট হবে মর্মে সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে দেয়নি।

 

 

৩৬ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *