পেশা ছাড়ছেন নারান্দিয়ার হাতে ভাজা মুড়ির কারিগররা

কালিহাতী টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল স্পেশাল লিড নিউজ

কাজল আর্য ॥
টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়ার মুড়ির চাহিদা দেশজুড়ে। পবিত্র রমজান মাসের ইফতারির রকমারি উপাদানের মধ্যে মুড়ি অত্যাবশকীয়। মুড়ির চাহিদা সারা বছরব্যাপী থাকলেও রোজার সময় উৎপাদন এবং বিক্রি বহুগুণে বেড়ে যায়। ফলে মুড়ি ব্যবসায়ীরা বছর জুড়ে অপেক্ষায় থাকেন রমজান মাসের জন্য। আবার অনেকে এ মাসে সিজনাল ব্যবসা হিসেবে এই মাসে মুড়ি উৎপাদন এবং বিক্রি করে থাকেন। বর্তমানে এখানকার মুড়ি তৈরির কারিগর ও ব্যবসায়ীদের দম ফেলার ফুসরত নেই।
টাঙ্গাইলসহ দেশের ৮ জেলায় মুড়ি সরবরাহ হয়ে থাকে জেলার কালিহাতীর নারান্দিয়া থেকে। এখানকার উৎপাদিত মুড়ির সুনাম দেশের বিভিন্নস্থানে। মুড়ি উৎপাদনের সাথে নারান্দিয়ার মানুষ অনেক পূর্বে থেকেই জড়িত। এখানে দুইভাবে মুড়ি উৎপাদিত হয়, হাতে ভেজে ও মেশিনের সাহায্যে। মুড়ি উৎপাদনকারি এলাকাগুলোর মধ্যে নারান্দিয়া শীর্ষে। এখনো নারান্দিয়া ইউনিয়নের শতাধিক বাড়িতে হাতে ভেজে মুড়ি উৎপাদিত হয়। মেশিনের সাহায্যে মুড়ি উৎপাদন নতুন সংযোজন হলেও অনেক আগে থেকেই হাতে ভেজে মুড়ি তৈরি এবং বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে শতাধিক পরিবার। হিন্দু, মুসলিম উভয় মানুষ মুড়ি ভাজার সাথে যুক্ত থাকলেও মোদক সম্প্রদায়ের মানুষই বেশি এ পেশায় রয়েছেন।
এছাড়া উপজেলার নারান্দিয়া, মাইস্তা, নগরবাড়ী, দৌলতপুর, লুহুরিয়া ও সিংহটিয়াসহ প্রায় ১৫টি গ্রামের কয়েকশ’ পরিবার হাতে ভেজে মুড়ি তৈরি করে থাকে। একজন ব্যক্তি ১ দিনে এক থেকে দেড় মণ চালের মুড়ি ভাজতে পারেন। প্রতি মণ চালে ২২ থেকে ২৩ কেজি মুড়ি হয়। প্রতি কেজি মুড়ি পাইকারি ৯০-১০০ টাকা এবং খুচরা ১১০-১২০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে। মূলত গ্রামের মহিলারাই হাতে ভেজে গুণগত মানসম্মত মুড়ি তৈরি করেন।
দৌলতপুর গ্রামের রাধা রানী মোদক বলেন, আমরা বংশ পরম্পরায় মুড়ি ভাজা ও ব্যবসার সাথে জড়িত। আমি ৩৭ বছর ধরে মুড়ি ভাজি। ধান সিদ্ধ করে রোদে শুকানোর পর আবার সেই ধান মেশিনে মাড়াই করে মুড়ি ভাজার জন্যে চাল তৈরি করা হয়। পরে সেই চাল দিয়ে লবণ জলের মিশ্রণে আগুনে তাপ সহ্য করে বিশুদ্ধ মুড়ি ভাজতে অনেক পরিশ্রম হয়। সবকিছুর দাম বেশি। পরিশ্রমের তুলনায় তেমনটা লাভ হয় না। অধীর মোদক বলেন, মুড়ি ভাজার প্রতি মন ধান ১৪শ’ টাকা। এক মণ ধানের মুড়ি ভাজতে খড়ি, লবণ, যাতায়াত ও ধান ভাঙানোর খরচ আরো ১৫০ টাকা। সব খরচ বাদে বেশি লাভ হয় না। কনিকা রানী মোদক ও সুরেন্দ্র কুমার বর্মন বলেন, এক মণ ধানের মুড়ি ভাজলে ৪০০-৫০০ টাকা লাভ হয়। তা দিয়ে চলে না। আমরা সরকারি সহযোগিতা চাই। প্রতিবছরই চিৎকার করে বলি, কিন্তু কোন কাজে আসে না।
মুড়ির কারিগরসহ সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ টাকার হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদন এবং কেনাবেচা হয়। তবে পরিশ্রমের লাভ বেশির ভাগই চলে যায় মধ্যসত্বভোগীদের পকেটে। রমজান মাসে দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা পিকআপ, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে বস্তাভর্তি মুড়ি কিনে টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত এলাকায় বিক্রি করেন। যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল থাকায় পার্শ্ববর্তী সিরাজগঞ্জ, ঢাকা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, বগুড়া, শেরপুর ও গাজীপুরে নারান্দিয়ার মুড়ি সরবরাহিত হয়। তবে প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না হাতে ভাজা মুড়ির উৎপাদনকারীরা। মেশিনে মুড়ি ভাজতে সময় কম লাগে, কিন্তু তুলনামূলকভাবে লাভ বেশি। অন্যদিকে হাতে মুড়ি ভাজতে সময় বেশি লাগে, কিন্তু লাভ সামান্য। ফলে হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদনকারীরা দিনদিন এই কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় ধাবিত হচ্ছেন এবং অনেকেই চলে গেছেন। এই পেশাকেই টিকিয়ে রাখতে উৎপাদনকারী এবং ব্যবসায়ীরা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
সততা মুড়ির মিলের স্বত্বাধিকারী শংকর চন্দ্র মোদক বলেন, রমজানে আমরা অনেক সময় মোবাইলেও মুড়ির অর্ডার নিয়ে সরবরাহ করে থাকি। তাছাড়া নির্দিষ্ট বাজারে স্থায়ী গ্রাহকরা মুড়ি ক্রয় করে থাকেন। রমজান ছাড়া বছরের অন্য সময়ে অর্ধেকে নেমে আসে। শতাধিক পরিবার প্রত্যক্ষভাবে ও বিপুল সংখ্যক মানুষ পরোক্ষভাবে মুড়ি ব্যবসার সাথে জড়িত থেকে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। ফলে রমজানে কাজের চাপে দম ফেলার সময়টুকু পায়না মুড়ি উৎপাদনকারীরা। শংকর মোদক আরো বলেন, আমরা প্রতি কেজি মুড়ি ৭০ টাকায় বিক্রি করি। খুচরা ৮০-৯০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। ৫০ কেজি চালের বস্তায় ৪৩-৪৪ কেজি মুড়ি হয়। রমজান মাসে আমাদের মিলে গড়ে ১ লাখ টাকার কেনাবেচা হয়ে থাকে।
এদিকে মেশিনের সাহায্যে বিপুল পরিমান মুড়ি প্রতিনিয়ত উৎপাদিত হলেও হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। মেশিনে ভাজা মুড়ি সাদা ও লম্বা করতে ক্ষতিকর রাসায়নিক ইউরিয়া কিংবা সোডা ব্যবহারের অভিযোগ থাকায় একশ্রেণির মানুষ সর্বদাই বিষমুক্ত হাতেভাজা মুড়ি খেয়ে থাকেন।
নারান্দিয়া ইউপি সদস্য ইব্রাহীম মিয়া বলেন, মেশিনের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারছেন না হাতে ভাজা মুড়ির কারিগররা। ফলে জীবন জীবিকার তাগিদে তারা অন্য পেশায় ছুটছেন। প্রয়োজন যথাযথ ব্যবস্থাপনা। দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান মজনু বলেন, আমাদের এলাকাটি মুড়ি উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। কিন্তু পরিশ্রমের তুলনায় লাভ কম হওয়ায় হাতে ভাজা মুড়ির কারিগররা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। নারান্দিয়ায় মুড়ি কেনাবেচার একটি নির্দিষ্ট বাজার দরকার। সরকার থেকে হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদনকারী ব্যক্তি এবং পরিবারগুলোকে বিশেষ ঋণ সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন।
এ বিষয়ে কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসার খায়রুল ইসলাম বলেন, টাঙ্গাইল তথা বাংলাদেশের মধ্যে মুড়ি উৎপাদনের অন্যতম স্থান কালিহাতীর নারান্দিয়া। এখানকার উৎপাদিত লাখ লাখ টাকার মুড়ি সারাদেশে সরবরাহ হচ্ছে। এটি এক প্রকার কুটির শিল্প। মানুষের চাহিদা পূরণে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের যথাযথ উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষ করে হাতে ভাজা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে। কারিগরদের কম সুদে ঋণ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে সাহায্য করার উদ্যোগ নিবো। সেইসাথে হাতে ভাজা মুড়ির ব্র্যান্ডিং ও আরো প্রচার প্রসারের ব্যবস্থা করা হবে।

 

 

 

 

 

১৭ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *