স্টাফ রিপোর্টার ॥
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে দিনে-রাতে মাটি খেকোরা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা অবৈধভাবে মাটি কেটে ড্রাম ট্রাকে বহন করায় এলজিইডির অধীনে এলাকার আঞ্চলিক রাস্তা, ব্রিজ ও কালভার্টগুলোর মারাত্মক ক্ষতি করছে। বর্তমানে ওই সড়কগুলোতে ধুলোবালিতে চলাচল করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। কেউ প্রতিবাদ করলেই মাটি খেকোরা নানাভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে বলে ভুক্তভোগিরা অভিযোগ করেছেন।
দীর্ঘ দিন ধরে অবাধে চলছে অবৈধভাবে মাটি চুরির মহোৎসব। প্রভাবশালী মহলের দাপটে কোন ভাবেই অবৈধ এই মাটি চুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। মাটি চুরির ফলে রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট মারাত্বক ঝুঁকিতে পড়েছে। ড্রাম ট্রাক দিয়ে মাটি কেটে বহন করে নেওয়ায় এলাকার রাস্তাঘাটের যেমন ক্ষতি হচ্ছে। তেমনি পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে।
মির্জাপুর উপজেলা প্রকৌশলী ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, একটি মহল বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে মাটি চুরি করে ড্রাম ট্রাক দিয়ে বহন করায় এলজিইডির অধীনে গ্রামীণ আঞ্চলিক রাস্তাঘাট ও ব্রিজ-কালভার্টের ব্যাপক ক্ষতি করছে। অভিযানের পরও থামছে না। এই চক্রের হাতে প্রশাসন অসহায় হয়ে পড়েছে।
মির্জাপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে ও ভুক্তভোগিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি প্রভাবশালী চক্র দীর্ঘ দিন ধরে উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চল আজগানা, লতিফপুর, তরফপুর, গোড়াই ও বাঁশতৈল এই পাঁচ ইউনিয়নের পাহাড়ের টিলার লাল মাটি চুরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। মৌসুমের শুরু থেকেই পাহাড় ও নদীর মাটি কাটা হচ্ছে। দিনে-রাতে মাটি কাটায় এলাকার কাঁচা আধাপাকা রাস্তা ভেঙ্গে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পাহাড়ের লাল মাটি কাটায় একদিকে জীব বৈচিত্র ধ্বংস হচ্ছে। তেমনিভাবে এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
এলাকার অসহায় ভুক্তভোগিরা অভিযোগ করেন, প্রভাবশালীরা এলাকার অসহায় লোকজনকে জিম্মি করে জোরপূর্বক পাহাড়ের লাল মাটির টিলা ও ফসলি জমির মাটি কেটে নিচ্ছে। মাটি কাটা বন্ধের জন্য কেউ বাঁধা দিলে তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি এবং মামলার ভয় দেখানো হয়। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পাহাড় কাটার মহোৎসব। প্রতি রাতে শতাধিক ড্রাম ট্রাক দিয়ে মাটি নেওয়ায় এলাকার রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পেকুয়া-পাথরঘাটা রাস্তা, পেকুয়া-বালিয়াজান রাস্তা, তালতলা-গায়রাবেতিল রাস্তা, বাঁশতৈল-নয়াপাড়া রাস্তা, পাথরঘাপা-তরফপু-মির্জাপুর রাস্তা, পাথরঘাটা-তক্তারচালা রাস্তা, হাটুভাঙ্গা-কুড়িপাড়া-আজগানা রাস্তাসহ ১৫-২০টি আঞ্চলিক রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
এভাবে মাটি চুরির সঙ্গে জড়িত চক্রটি উপজেলার বংশাই ও লৌহজং নদীর মাটিও কেটে নিচ্ছে। বংশাই লৌহজং নদীর পাশপাশি মির্জাপুর পৌরসভা, মহেড়া, জামুর্কি, ফতেপুর, বানাইল, আনাইতারা, ওয়ার্শি, ভাতগ্রাম, ভাওড়া, বহুরিয়া, গোড়াই, লতিফপুর, আজগানা, তরফপুর ও বাঁশতৈল ইউনিয়নে এক শ্রেণীর মাটি ব্যবসায়ী ও ভুমি দস্যুরা আবাদি জমি, রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি এবং নদীর বুকে ভ্যেকু বসিয়ে দিনে-রাতে বালি এবং লাল মাটি কেটে নিচ্ছে। মির্জাপুর উপজেলার গোড়াইল, গাড়াইল, মীর দেওহাটা, বহুরিয়া, ফতেপুর, গোড়াই, তরফপুর, বাঁশতৈল আজগানাসহ বেশকয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মাটি ব্যবসায়ীরা পাহাড়ের টিলা ও নদীর বুকে ভ্যেকু বসিয়ে বালি এবং লাল মাটি কেটে নিচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ফতেপুর, থলপাড়া, চাকলেশ্বর, গোড়াইল, ত্রিমোহন নদীর ঘাট, কোদালিয়া, হাটুভাঙ্গা, সৈয়দপুর, আজগানা, দেওহাটা, কোর্ট বহুরিয়া, ওয়ার্শি, নাগরপাড়া, উফুলকী, গুনটিয়া, মাঝালিয়াসহ ৩০-৪০ স্পটে চলছে মাটি চুরির মহোৎসব। ফলে সরকার বিপুল পরিমান সরকারী রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভুক্তভোগি অন্তত ৩০ জন অভিযোগ করেন, অবৈধভাবে ড্রাম ট্রাক দিয়ে মাটি নেওয়ার ফলে বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাটি ব্যবসায়ীদের বাঁধা দিলে তারা অসহায় লোকজনদের ভয়ভীতি ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করছে। মাটি ব্যবসায়ীরা এতোটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তারা কোন পাত্তা দিচ্ছে না। দেওহাটা-বহুরিয়া রাস্তা, মীর দেওহাটা-যুগিরকোপা রাস্তা, সোহাগপাড়া-লতিফপুর রাস্তা, মির্জাপুর-পাথরঘাটা-বান্দরমারা রাস্তা, কুরনি-ফুতেপুর রাস্তা, কদিমধল্যা-বরাটী রাস্তা, পাকুর্যা-লাউহাটি রাস্তা, মির্জাপুর-ভাড়া-কামারপাড়া রাস্তাসহ ১৫-২০টি গ্রামীণ আঞ্চলিক রাস্তা বেহাল হয়ে পড়েছে। এছাড়া ড্রাম ট্রাক দিয়ে মাটি বহন করায় গুনটিয়া ব্রিজ, বরাটী দুখীরাম রাজবংশী ব্রিজ, পুষ্টকামুরী ব্রিজ, পাহাড়পুর ব্রিজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম ব্রিজ, ওয়ার্মি ব্রিজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা একাব্বর হোসেন ব্রিজ, তলপাড়া ব্রিজ, কোদালিয়া লতিফপুর ব্রিজ ও হাটুভাঙ্গা ব্রিজ হুমকির মুখে পড়েছে।
এ ব্যাপারে মির্জাপুর উপজেলা প্রকৌশলী মনিরুল সাজ রাজন বলেন, একটি মহল বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে মাটি চুরি করে ড্রাম ট্রাক দিয়ে বহন করায় এলজিইডির অধীনে গ্রামীণ আঞ্চলিক রাস্তাঘাট ও ব্রিজ-কালভার্টের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে বলে এলাকার লোকজন অভিযোগ করছেন। প্রশাসন থেকে ইতিমধ্যে অভিযান শুরু হয়েছে। যেসব রাস্তাঘাট ও ব্রিজ কালভার্টের ক্ষতি হয়েছে অর্থ বরাদ্দ পেলে দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা করা হবে।
এ বিষয়ে মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ বি এম আরিফুল ইসলাম ও সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মাসুদুর রহমান বলেন, বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে মাটি বহন করার ট্রাক জব্দ এবং অন্তত অর্ধ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ও পুলিশের সহায়তায় দিন ও রাতে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান শুরু হচ্ছে এবং তাদের অভিযান চলমান থাকবে বলে এই দুই কর্মকর্তা উল্লেখ করেন।