
স্টাফ রিপোর্টার, মির্জাপুর ॥
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে উপজেলার সাহাপাড়া মাঠে ও পুষ্টকামুরী পশ্চিমপাড়া লৌহজং নদীর পারে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই পূজায় চারজন সন্ন্যাসীর (ভক্ত) পিঠেবড়শি গেঁথে চড়ক ঘোরানো হয়। মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) বিকেলে মির্জাপুর পৌর এলাকার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাহাপাড়া গ্রামের মাঠে চরক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই চরকপূজায় সহোদর দুইভাইসহ তিনজন সন্ন্যাসী পিঠে বড়শি গেঁথে চড়ক ঘুরেন।
এছাড়া সোমবার (১৪ এপ্রিল) পৌর এলাকার দুই নম্বর ওয়ার্ডের পুষ্টকামুরী পশ্চিমপাড়া এলাকায় লৌহজং নদীর পারে একজন সন্ন্যাসীকে পিঠে বড়শি গেঁথে চড়ক ঘোরানো হয়।
উপজেলার সাহাপাড়া মাঠে সরেজমিনে দেখা গেছে, চড়ক পূজাকে কেন্দ্র করে পাঁচ সহস্রাধিক উৎসুক দশনার্থীরা ভিড় জমিয়েছেন। চড়ক ঘোরানোর জন্য পৌর এলাকার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের গৌর সরকারের ছেলে দুলাল সরকার ও প্রদীপ সরকার এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাহাপাড়া গ্রামের গৌর সূত্রধরের ছেলে কানাই সূত্রধর (তিন সন্ন্যাসী) পিঠে বড়শি গেঁথে চরকে ঘুুরার জন্য অপেক্ষা করছেন। দুলাল সরকার গাছের নিচে পূজা দিচ্ছেন। এর আগে তারা ঘুরে ঘুরে ভক্তদের কাছ থেকে টাকা তুলেছেন। ভক্তরা তাদের কাছে মানত করে কবুতর, কলা, আম, বাতাসাসহ বিভিন্ন প্রসাদ দিচ্ছেন।
পূজা শেষে সন্ধ্যার আগে গাছের এক পাশে রশির সাথে বড়শিতে গেঁথে এক ভক্তকে বেধে দেয়া হয়। এরপর অন্য পাশ থেকে দড়ি টেনে ঘোরানো হয়। চড়ক ঘোরানোর সময় শঙ্খ ধ্বনি ও ঢাক ঢোল বাজানো হয়। এভাবে একে একে তিনজন সন্ন্যাসী (ভক্ত) চরক ঘুরেন। সন্ন্যাসীরা চরকে ঘোরার সময় তার হাতে থাকা লাল থলির মধ্যে রাখা বাতাসা, কলা, আম সহ বিভিন্ন প্রকারের প্রসাদ দর্শনার্থীদের উদ্দেশে ছুরে দেন। এ সময় উৎসুক জনতা সেগুলো টুকিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ওইসব প্রসাদ খেলে জটিল রোগ থেকে মুক্তি ও নারীরা সন্তান লাভ করতে পারে বলে ভক্তরা জনিয়েছেন।
এদের মধ্যে দুলাল সরকার ১৯/২০ বছর, সহোদর ছোট ভাই প্রদীপ সরকার ১৫ বছর এবং কানাই সূত্রধর ২ বছর ধরে চড়ক ঘুরছেন। এছাড়া দুলাল সরকারের বড় ভাই সঞ্জয় সরকার ৬ বছর চড়ক ঘুরেছেন বলে জানা গেছে।
শত বছরের পরম্পরায় এ পহেলা বৈশাখ বিকেলে চড়কপূজা পালন করেন মির্জাপুরের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। চড়কপূজাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মন্দিরে কয়েক দিন ধরে হরগৌরী নৃত্য, অসিনৃত্য, শিবের গাজন করা হয়। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এ চড়ক ঘোরানো হয়। এ উপলক্ষে অনেক জায়গায় এক দিনের মেলা বসে।
মির্জাপুর উপজেলার বহুরিয়া ইউনিয়নের মন্দিরাপাড়া গ্রামের সাইফুল ইসলাম নামে একজন দর্শক বলেন, আমার ছোট বোনের ১০ বছর আগে বিয়ে হলেও কোনো সন্তান নেই। শুনেছি সন্ন্যাসীর কামড়ে দেয়া আম খেলে সন্তান লাভ করা যায়। সন্ন্যাসীর কাছ থেকে তার কামড়ে দেয়া একটি আম পেয়েছি। সন্তানের আশায় সৃষ্টিকর্তার নামে আমটি বোন ও ভগ্নিপতিকে খাওয়াবো। সাহাপাড়া মাঠে চড়ক পূজার আয়োজকদের অন্যতম ঝন্টু সরকার বলেন, মহাদেব ঠাকুরের পূজা ও আরাধনা করা হয়। প্রতিবছর এখানে চড়ক ঘোরানো হয়। সনাতন ধর্মের মানুষদের পুণ্যের আশায় এ চড়কপূজার আয়োজন করে থাকেন বলে তিনি জানান।
চড়ক পূজার অন্যতম আয়োজক মন্টু সরকার বলেন, চড়ক পূজার জন্য এক মাস নিরামিষ ভোগ করছি। রাজাদের আমল থেকে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ছোটবেলা থেকেই এ চড়ক ঘোরানো দেখে আসছি। আমার দাদা, আমার পিতার পর আমিও এ আয়োজনের সঙ্গে জড়িত। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুযায়ী, চড়কপূজার মাধ্যমে তারা দেব-দেবীর আশীর্বাদ লাভ করেন।
পূজা শেষে কথা হয় চড়কে ঘোরানো প্রদীপ সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ নিয়ে আমি ১৫ বার চড়ক হিসেবে ঘুরেছি। আমার বড় ভাই সঞ্জয় সরকার ৬ বছর এবং আরেক বড় ভাই দুলাল সরকার ১৯/২০ বছর ধরে চড়ক হিসেবে ঘুরছে। আমি এবং অন্য দুই ভাই সুস্থ আছি। কোনো দিনই কোনো সমস্যা হয়নি। পুণ্য লাভের আশায় পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এ কষ্ট করি। যাদুমন্ত্রের বিষয় রয়েছে।
তাদের হাতে থাকা লাল থলি থেকে ফেলা প্রসাদ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চড়ক থেকে ফেলা প্রসাদ দর্শনার্থীরা সংগ্রহ করে রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় খেয়ে থাকেন। এছাড়া যাদের সন্তান হয় না তারা খেলে সন্তান লাভ করে এই বিশ্বাসে প্রসাদ সংগ্রহ করে খেয়ে থাকেন বলে তিনি জানান।
পুষ্টকামুরী পশ্চিমপাড়া চড়ক পূজার আয়োজক ভীম কুমার রাজবংশী বলেন, পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য পালন করে চলেছি। এ বছরও তাদের আয়োজনে লৌহজং নদীর পারে পুষ্টকামুরী পশ্চিমপাড়া এলাকায় চড়ক পূজার আয়োজন করেছিলাম। আন্ধরা গ্রামের কৃষ্ণ রাজবংশী দশমবার চড়ক ঘুরেছেন বলে তিনি জানান।