হাবিবুর রহমান, মধুপুর ॥
গ্রাম বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্য ও বাঙালির সংস্কৃতির সাথে নানা পেশা ধর্ম-বর্ণ জাতিগোষ্ঠীর মানুষের এক নিবিড় সম্পর্ক। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক পার্বন ও পর্বে। আদি বিভিন্ন পেশার মানুষদের নানা আচার অনুষ্ঠান ও তাদের তৈরিকৃত তৈজসপত্র বাঙালির ঐতিহ্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি তাদের পেশাও সমৃদ্ধ হয়েছে। তবে আধুনিকতার কারণে অনেক লোকেরা তাদের বংশ পরম্পরায় লালিত তাদের পেশার টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। পাল পাড়ায় গেল পহেলা বৈশাখে কোন হৈচৈ পড়েনি। নেই তাদের আগ্রহ। কারিগর শ্রমিক আর নিজেদের মজুরি তোলাই যেখানে কষ্টসাধ্য। সেখানে বৈশাখের সৌখিন জিনিসপত্র তৈরি করা হয়ে উঠেনি। শুধু এ বছরই নয়, কয়েক বছর যাবত চলছে তাদের এমন অবস্থা। এসব কারণে জৌলুস হারাচ্ছে তাদের বংশ পরম্পরায় পাওয়া এ পেশা। টাঙ্গাইলের মধুপুরের জলছত্র পালপাড়ায় গিয়ে কুমারদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
মধুপুর শহর থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে বেরিবাইদ ও অরণখোলা ইউনিয়নের জলছত্র গ্রামে পালদের ২৪-২৫ পরিবার কুমারদের বসবাস। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশেই আনারস বাজারের দু'পাশে ৩০-৩৫ বছর যাবত বাস করছে। পাল পাড়ায় গিয়ে নারী-পুরুষদের সাথে কথা বলে জানা যায় তাদের বাপ-দাদার পেশার নানা সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা।
এরা কেউ এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা নয়। তাদের পূর্ব পুরুষেরা দুই তিন যুগ আগে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন জায়গা থেকে বসতি গড়ে মাটির বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ শুরু করে। এভাবে জলছত্র গ্রামে তাদের বসতি। স্থানীয় চাড়ালজানি হাওদাবিলসহ বিভিন্ন বিলের মাটি এনে তারা হাড়ি পাতিলসহ নানা মাটির জিনিসপত্র বানাতো। এক সময় মাটি কিনতে না হলেও এখন কিনে আনতে হয়। শ্রমের মজুরি বেড়েছে। আনুপাতিকহারে বাড়েনি তাদের মাটির জিনিসের দাম। গ্রামে এক সময় তাদের তৈরি মাটির জিনিসপত্রের কদর ও চাহিদা থাকলেও প্লাস্টিকের কারণে চাহিদা কমে গেছে। এখন শুধুই জীবিকা আর বাপদাদার পেশাকে টিকিয়ে রাখতেই মাটি দিয়ে তৈরি করছে এমনটাই জানালেন তারা। তবে তাদের ছেলে-মেয়েরা এখন অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। কেউ মিষ্টির দোকানে, কেউ বিপনি কেন্দ্রে। কেউবা আবার দিন মজুরির কাজে। তাদের মতে, বংশ পরম্পরার এ পেশাকে টিকিয়ে রাখা এখন তাদের কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও আধুনিক মানের মাটির জিনিসপত্র তৈরির প্রশিক্ষণসহ বাজার ব্যবস্থা করতে পারলে বর্তমান সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে পারবে বলেও মনে করছেন তারা।
গ্রামের সুদেব পাল (৩৫) জানালেন, মাটি কিনে ভ্যান ভাড়া দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসতে আগের চেয়ে খরচ অনেক বেশি। গ্রামে গ্রামে বিক্রি করাও কমে গেছে। চাহিদাও কম। সারাদিন ঘুরে ঘুরে বিক্রিত টাকায় পোষানো কঠিন। পারুল রানী পাল (৩৫) জানালেন, তাদের দুটি এনজিওতে সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয়। তাই এখন হাড়ি, পাতিল, পুতুল, খেলনা তৈরি না করে শুধু দইয়ের পাতিল তৈরি করে। অর্ডার নিয়ে তৈরি করে। শুধু তিনিই নয়, তাদের পাড়ায় সবাই একই ধরনের কাজ করে। গত বৈশাখের জন্য তারা কোন শৌখিন জিনিসপত্র তৈরি করেনি।
সুমতি রানী পাল (৬০) জানালেন, নতুন করে কেউ এ কাজ করতে চায় না। যারা পুরানো তারাই এ কাজ করছে। তার মতে, সব পেশার মানুষরা আয় উন্নতি করতে পারলেও তারা পারছেন না। হাট বাজারে এ সময় মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা থাকলেও সেখানে এখন প্লাস্টিকের চাহিদা বাড়ছে। আরতি রানী পাল (৫৯) জানালেন, তারা বংশ পরম্পরায় এ কাজ করে আসছে। এ সময় তাদের এ গ্রামে চাক ঘুরিয়ে হাড়ি-পাতিল, খেলনাসহ বাহারি জিনিসপত্র তৈরি হতো। এখন চাক ঘুরে না। পোষায় না তাদের। তাদের মতে, প্রায় সবারই এনজিও থেকে লোন নিয়েছে, তাদের কারো দুইটা কারো একটা সাপ্তাহিক কিস্তির টাকা গুণতে হয়। এভাবে কয়েক যুগেও তাদের পেশার কোন গুণগত পরিবর্তন ঘটেনি।
তুলসী রানী পাল জানালেন, এ গ্রামে ২৪-২৫ ঘর কুমারদের সবার অবস্থা এমনই। শিক্ষা দীক্ষায়ও তেমন এগিয়ে যেতে পারেনি। নারী-পুরুষদের মধ্যে বয়স্করা এ কাজেই আছে। তবে নতুন বিভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কুমারদের পেশাও টিকে থাকবে। এগিয়ে যেতে পারবে তারা এমনটাই মনে করছে এখানকার কুমার পল্লীর মানুষেরা।